ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই কিছু ভুঁইফোড় তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা হিন্দু শাস্ত্রীয় নিয়মগুলোকে ‘কুসংস্কার’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায় ৷ ‘গরুর মাংস ভক্ষণকারী’ সিপিএমের নেতা ও আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য্য তো হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে প্রকাশ্যে বিদ্রুপ পর্যন্ত করেছেন । হিন্দু শাস্ত্রের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আচারের মধ্যে শাঁখ বাজানোকেও তারা কুসংস্কার বলে মনে করে । আসলে, হিন্দু ধর্মে শঙ্খকে পবিত্র প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা এবং শুভ সূচনায় বাজানো হয় । সকাল-সন্ধ্যায় শাঁখ বাজানোর রীতি প্রচলিত আছে । বৈদিক শাস্ত্রে শাঁখ বাজানোর বহু উপকারিতার কথা বলা আছে । আর এবার আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা শাঁখ বাজানোর রীতি নিয়ে একটা চমকপ্রদ গবেষণালব্ধ তথ্য তুলে ধরেছে । সম্প্রতি জয়পুরের ইটারনাল হার্ট কেয়ার সেন্টার এবং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা দাবি করেছেন, শাঁখ বাজালে অনিদ্রা দূর হয় ৷ কেউ যদি ছয় মাস নিয়মিত শাঁখ বাজান তাহলে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার (Obstructive Sleep Apnea বা OSA) উপসর্গ অনেকটাই কমে।
প্রসঙ্গত,অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বা সংক্ষেপে ওএসএ হল একটি ঘুমের ব্যাধি যেখানে ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বারবার বন্ধ হয়ে যায় এবং শুরু হয়। এটি ঘটে যখন গলার পেছনের পেশীগুলি শিথিল হয়ে শ্বাসনালী বন্ধ করে দেয়, ফলে বায়ুপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয় । ওবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন, বড় টনসিল বা এডিনয়েড, ছোট চোয়াল বা দুর্বল চোয়ালের গঠন, নাক বন্ধ হওয়া বা সাইনাসের সমস্যা, ঘুমের সময় শ্বাসনালীর পেশীগুলির শিথিলতা হল মূলত এই রোগের কারণ । এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ায়। এর কিছু লক্ষণ হল জোরে নাক ডাকা,দিনের বেলায় অতিরিক্ত ক্লান্তি বা ঘুম ঘুম ভাব,ঘুম থেকে উঠার পর মাথাব্যথা,ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়া বা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া,মনোযোগ কমে যাওয়া বা স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ওজন প্রভৃতি ৷
সেক্ষেত্রে ওই গবেষকরা বলছেন, সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন ১৫ মিনিট শাঁখ বাজালে ঘুম সম্পর্কিত সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার পাশাপাশি নাক ডাকা ও দিনেরবেলা ঘুমোনোর প্রবণতা কমতে পারে। রাজস্থানের জয়পুরের ইটারনাল হার্ট কেয়ার সেন্টার এবং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ডাঃ কৃষ্ণ শর্মার মতে, তাঁর বেশ কিছু রোগী যারা শাঁখ বাজানো অভ্যাস করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে উপসর্গ কিন্তু কম দেখা গিয়েছিল। সমীক্ষায় আরও দেখা গিয়েছে, ডিপ ব্রিদিং নেওয়া লোকেদের তুলনায় শাঁখ বাজানো লোকেদের দিনে ঘুম ঘুম ভাবের হার ৩৪ শতাংশ কম। সেইসঙ্গে রাতে ভালো ঘুম হওয়ার পাশাপাশি তাঁদের রক্তে অক্সিজেনও উচ্চ মাত্রায় ছিল।
শাঁখ বাজালে কেন এই অপসর্গের মাত্রা কমে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি । ডাঃ কৃষ্ণ শর্মা জানান যে আসলে শাঁখ বাজাতে গেলে গভীরভাবে শ্বাস নিতে হয়, যা দীর্ঘক্ষণ ধরে ছাড়তে হয়। এতে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়ে। শ্বাসযন্ত্রের ব্যায়াম হয় । তবে তিনি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে এটি শুধুমাত্র প্রুফ-অফ-কনসেপ্ট স্টাডি, আরও গবেষণার প্রয়োজন । মদ্যপান ও অনিয়মিত জীবনযাপন করে শুধুই শাঁখ বাজালেই যে অনিদ্রার রোগ সারবে সেটা মনে করা ভুল বলে মনে করেন তিনি । তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে পাশাপাশি মদ্যপানের অভ্যাস বর্জন ও অনেক রাত জেগে ঘুমতে যাওয়ার অভ্যাসও বর্জন করতে হবে ।
এছাড়া যর্যুবেদ এবং আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষ্যমতে শঙ্খ থেকে উৎপন্ন কম্পন যে তরঙ্গের সৃষ্টি করে তা বাতাসের সাথে মিশে থাকা জীবাণুকে ধ্বংস করে। নিয়ম মাফিক শঙ্খ বাজালে, বাদকের মস্তিষ্কের গোড়ার সুষুম্না কাণ্ড সতেজ থাকে, রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় এবং রাজসিক ও তামসিক তরঙ্গের অন্তর্গত তেজ ও বায়ুর উপাদানগুলো সাম্যাবস্থায় থাকে বলে শাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে ।
ডাঃ কৃষ্ণ শর্মা আরও বলেন,’এটি একটি ছোট গবেষণা, কিন্তু আমরা এখন বেশ কয়েকটি হাসপাতালকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি বৃহত্তর পরীক্ষার পরিকল্পনা করছি। এই পরবর্তী পর্যায়ে আমরা একটি বৃহত্তর, আরও বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর উপর আমাদের ফলাফল যাচাই এবং সম্প্রসারণ করতে এবং দীর্ঘ সময় ধরে শঙ্খ ফুঁ দেওয়ার কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে সক্ষম হব। আমরা আরও বিস্তারিতভাবে অধ্যয়ন করতে চাই যে এই অনুশীলনটি কীভাবে শ্বাসনালীর পেশীর স্বর, অক্সিজেনের মাত্রা এবং ঘুমকে প্রভাবিত করে। আমরা বিশেষ করে CPAP-এর মতো স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসার সাথে শঙ্খ ফুঁ দেওয়ার তুলনা করতে এবং OSA-এর আরও গুরুতর রূপগুলিতে এর সম্ভাব্য সাহায্য পরীক্ষা করতে আগ্রহী।’
হিন্দু ধর্মে শঙ্খের গুরুত্ব :
পবিত্র সনাতন ধর্মে শঙ্খ ভগবান বিষ্ণুর প্রতীক। একে বিষ্ণুর অর্ধাঙ্গী হিসেবেও পূজো করা হয়। সৃষ্টির শুরুতে সমুদ্রগর্ভ হতে, পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণু ও স্বর্গীয় দেবতাদের তৈরী ঘূর্ণাবর্তের মধ্য থেকে অস্ত্ররূপে শঙ্খকে হাতে ধরে আবির্ভাব হয় ভগবান বিষ্ণুর। অপরদিকে শঙ্খ ধন ও প্রতিপত্তির দেবী মা লক্ষীর আব্রু। “ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ” মতে, শঙ্খ ভগবান বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীর অধিষ্ঠানকারী মন্দির।।