শ্রীমদভগবদগীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৭২ তম শ্লোকে অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন :
এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি ।
স্থিত্বাস্যামন্তকালেহপি ব্রহ্মনির্বাণমৃচ্ছতি ॥৭২॥
শ্লোকটির অনুবাদ হল : এই প্রকার স্থিতিকেই ব্রাহ্মীস্থিতি বলে। হে পার্থ ! যিনি এই স্থিতি লাভ করেন, তিনি মোহপ্রাপ্ত হন না । জীবনের অন্তিম সময়ে এই স্থিতি লাভ করে, তিনি এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করেন।
ব্রাহ্মীস্থিতি সম্পর্কে যোগীরাজ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা “শ্যামাচরণ ক্রিয়াযোগ ও অদ্বৈতবাদ” পুস্তকে বলা হয়েছে : ভগবান্ গীতায় এই শ্লোকের আগের শ্লোকগুলিতে যে যে প্রকার মহানন্দ, শান্তি বা ব্রাহ্মীস্থিতির বর্ণনা করেছেন তার উপসংহার করতে গিয়ে এই শ্লোকে বলছেন-কর্মের অতীতাবস্থায় যে স্থিতি-প্রাপ্তিরূপ ব্রহ্মনিষ্ঠা বা ব্রাহ্মীস্থিতি তা এই প্রকার। যখন প্রাণকর্ম করতে করতে প্রাণাপানের গতিরুদ্ধাবস্থা লাভ হয় সেই অবস্থাকেই কর্মের অতীতাবস্থায় স্থিতি-প্রাপ্তিরূণ ব্রাহ্মীস্থিতি বলা হয়। প্রাণের আগম-নিগমরূপ কর্মের অতীতাবস্থাই অর্থাৎ নিরুদ্ধাবস্থাই ব্রহ্মপদবাচ্য, কারণ আত্মার যে বৃহৎ অবস্থা বা মহান অবস্থা সেই অবস্থাকেই ব্রহ্ম বলা হয়। আত্মার এই মহান অবস্থা অপেক্ষা আর কিছুই মহান নেই। এই মহান অবস্থা যাঁর ক্ষণকালের জন্যও প্রত্যক্ষ হয়েছে, কেবল তিনিই উহা অবগত আছেন। এই অবস্থা নিজবোধগম্য এবং অব্যক্ত। শাস্ত্র পড়ে বা কারো মুখে শুনে এই অব্যক্তরূপী মহানন্দাবস্থাকে জানা যায় না। যা মুখে বলা যায় বা শুনে জানা যায় তা কখনই ব্রহ্ম হতে পারে না। যেমন ‘কর্মের অতীতাবস্থা’ এই কথা বলাতে বা শোনাতে সঠিক অবস্থার কথা বলা, প্রকাশ করা বা শোনা হোলো না।
কর্ম একটা অবস্থা মাত্র বা যা কিছু করা যায় তাকেই কর্ম বলে। কর্মের মধ্যে অকর্ম এবং কর্ম দুইই আছে। সাধারণ মানুষ জাগতিক ভাবে যত প্রকার কর্ম করে সেগুলির সঙ্গে ফলাকাঙ্খা মিশ্রিত থাকায় সবই অকর্ম। দান, ধ্যান, সৎকর্ম, পূজা, সেবা, দয়া, তীর্থভ্রমণ ইত্যাদি যেসব কর্মগুলিকে আমরা ঈশ্বর প্রাপক কর্ম বলে থাকি, আসলে যোগীর কাছে এগুলিও অকর্ম। কিন্তু সাধারণ মানুষ যা জানে না, যা করে না, যা কেবল মাত্র গুরুবক্ত গম্য সেই নিষ্কাম অন্তর্মুখী প্রাণকর্মই যোগীদের প্রকৃত বা একমাত্র কর্ম। কারণ জাগতিক সকল কর্মই মন, বুদ্ধি বা ইন্দ্রিয়গণ দ্বারা যেহেতু অনুষ্ঠিত হয় তাই সেসব কর্ম অকর্ম। এই প্রাণকর্মের অস্তিত্বেই সকল প্রকার গুণাদিসম্পন্ন দেবদেবীগণের ও ইন্দ্রিয়গণের অস্তিত্ব এবং এই প্রাগকর্ম বহির্মুখীভাবে সকল জীবদেহে অজপারূপে অবস্থিত।
জীব যখন এই অন্তর্মুখী প্রাণকর্মের তত্ত্ব বা রহস্য বুঝতে পারবে, তখন আপনা হতেই জীবের মন, বুদ্ধি সবকিছু সম্মাদি স্তূণের ও ইন্দ্রিয়াদি গুণের সেবা ছেড়ে দিয়ে প্রাণের সেবারূপ নিষ্কাম আত্মকর্মে নিযুক্ত হবে এবং এই প্রাণকর্ম করে কর্মের অতীতাবস্থায় আত্মার মহান অবস্থা বা প্রাণের স্থিরাবস্থা উপলব্ধি করবে। এই মহান, অবস্থার কথা যা কিছু বলা যায় বা শোনা যায় তা সবই আভাষমাত্র। যেমন লোকে ‘মৃত্যু’ এই শব্দটা বলে থাকে, কিন্তু মৃত্যুরূপ অবস্থাটা যে কি তা কেউ বলতে পারে না; যিনি মরেছেন তিনিও বলতে পারেন না এবং যিনি জীবিত, তিনি ত ঐ অবস্থার কথা জানেনই না। কিন্তু যিনি জীবনযুক্ত অবস্থা লাভ করেছেন অর্থাৎ মৃত্যুরূপ অবস্থাটা যে কি, তা যিনি সাধন দ্বারা মরবার আগে জেনেছেন, তিনি ঐ তত্ত্ব বা রহস্য কেবল মাত্র নিজেই জ্ঞাত আছেন। মৃত্যুরূপ এই স্কিরাবস্থা দেহাবসানের পূর্বেই জ্ঞাত হওয়ায় এই প্রকার যোগী মৃত্যুভয়ে কখনই ভীত হন না। কিন্তু যিনি যোগী নন তাঁর দেহাবসানের পূর্বে এই প্রকার স্কিরাবস্থার জ্ঞানলাভ না হওয়ায় তিনি মৃত্যুভয়ে ভীত হন; কারণ মৃত্যুরূপ স্থিরাবস্থা যে কি তা তিনি জানেন না, তাই তিনি ভীত হন। তবে এটা ঠিক যে মৃত্যুরূপ একটা অবস্থা নিশ্চয় আছে এবং তা কারো অভিপ্রেত নয়। বর্তমান পিশাচী চঞ্চল মন ও বুদ্ধি এই ভাবে সকলকে ভয়ে ভীত করছে তাই জীব সর্বদা মৃত্যু
ভয়ে ভীত। মন ঐ পিশাচী বুদ্ধির ছলনায় অজপারূপ প্রাণকর্মে লক্ষ্য করতে দিচ্ছে না।
এই প্রাণকর্মের অভ্যাস গুরুপদেশে লাভ করে নিষ্ঠা সহকারে করতে থাকলে যখন কর্মের অতীতাবস্থায় স্থিতিলাভ হবে, তখন জীব আপনাহতেই সেই অনির্বচনীয় আনন্দের অবস্থা বুঝতে পারবে এবং তখন স্বসংজ্ঞাকে জানতে পারায় ভয়ের লেশমাত্র থাকবে না। ‘এই অবস্থা তখন স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ হওয়ায় মৃত্যুভয় রহিত হয়। জীবদ্ধশাতেই মৃত্যু যে কি, এইভাবে তা অবগত হলে জনম-মরণ দুইই তখন সমান অবস্থায় পরিণত হয়; একেই জীবন্মৃত অবস্থা বলে। বর্তমান অবস্থাটা সম্পূর্ণ না হলেও অন্তত আংশিক জানা থাকায় এই অবস্থার প্রতি কারো ভয় থাকে না, কিন্তু মৃত্যুরূপ অবস্থাটা সম্পূর্ণ অজানা থাকায় যত ভয়। তাহলে বোঝা গেল যে এই দুই অবস্থার বিষয়ে ভয় ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ অজানা, কিন্তু যখন জানা হোলো তখন নির্ভয়। এ এক অনির্বচনীয় আনন্দের অবস্থা এবং এই অবস্থা প্রাপ্তির জন্যই যত কিছু সাধন-ভজন করা। এই অবস্থা পেলে যোগীর আর সংসার-মোহ থাকে না, মৃত্যুকালেও যোগী এই প্রকার চৈতন্য অবস্থা থেকে কর্মের অতীতাবস্থায় অর্থাৎ স্থিরাবস্থায় ব্রহ্মেতেই লয় প্রাপ্ত হন। এই অবস্থাকেই ব্রহ্ম-নির্ব্বাণ অবস্থা বলে। নির্ব্বাণ অর্থাৎ নাই বাণ। বাণ অর্থে শর বা শ্বাস অর্থাৎ শ্বাসের আগম-নিগমরূপ গতিরুদ্ধাবস্থা। তাই যোগিরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী বলেছেন এই অবস্থায় যে ব্রহ্মানন্দ তা কখনও মুখে বলা যায় না। যে যোগী এই প্রকার নির্বাণ অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছেন তিনি প্রাণের বর্তমান চঞ্চল অবস্থাটাকে যেমন পুরোপুরি জানেন তেমনি মৃত্যুর পর অবস্থাটাও পুরোপুরি জানেন। সাধারণ মানুষ আগামীকাল কি ঘটতে পারে এটা হয়ত অনেক সময় জানে না কিন্তু যোগী উভয় অবস্থাকে জানতে পারেন।।