২৫ জানুয়ারী ২০০৫… সেই শীতের দুপুরে, যখন এলাহাবাদের (বর্তমানে প্রয়াগরাজ) রাস্তায় হালকা রোদ ছড়িয়ে পড়েছিল। সময়টা ছিল প্রায় বিকেল তিনটে । বিএসপির ক্যারিশম্যাটিক এবং আশা -উদ্দীপক বিধায়ক রাজু পালের মুখে ছিল দ্বিগুণ আনন্দ– তিন মাস আগে বিধায়ক নির্বাচিত হওয়ার গর্ব এবং মাত্র নয় দিন আগে বিয়ে করার আনন্দ। এটি ছিল তার জীবনের সোনালী সময়। রাজনীতিতে সতেজতা ছিল, বাড়িতে নতুন জীবন শুরু করার উত্তেজনা । সেদিন তিনি কোনও কাজে বাইরে গিয়েছিলেন, তাঁর সাথে কিছু সঙ্গীও ছিলেন। তিনি নিজে এসইউভি চালাচ্ছিলেন, যেমনটি তিনি সবসময় করতেন -সহজ, সরল,নিরহংকারী এক যুবক ।
কিন্তু ধুমানগঞ্জ এলাকার নীভা ক্রসিংয়ের কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথেই তার চোখ পড়ে স্কুটারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক দম্পতির উপর। মহিলাটি তার পূর্ব পরিচিত । দেখা গেল স্কুটারের তেল শেষ হয়ে গেছে। এক মুহূর্তও নষ্ট না করে রাজু মহিলাকে তার গাড়িতে তুলে নিল তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য । তার স্বামী স্কুটারটি নিয়ে পেট্রোল পাম্পের দিকে চলে গেল। এই মানবতাই রাজুকে মানুষের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিল । কিন্তু ভাগ্যে লেখা ছিল অন্য কিন্তু কিছু । যা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেননি ।
রাজুর এসইউভি গাড়িটি একটু এগিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ, সামনে একটি গাড়ি এসে থামল এবং পেছন থেকে আরেকটি গাড়ি পথ আটকে দিল। অবরোধ এত দ্রুত ঘটেছিল যে কেউ কিছু বুঝতেই পারলেন না তিনি। পরের মুহূর্তেই গুলির ঝরনা শুরু হয়ে গেল। যেন এসইউভির চারপাশে আগুনের বলয় তৈরি হয়েছিল। গুলির শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, আশেপাশের লোকেরা চিৎকার করে এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছিল। রাজু পরিস্থিতি বুঝতে পেরে চালকের আসন থেকে উঠে নিজের জীবন বাঁচাতে দৌড়ে গেল। কিন্তু এটি কোনও সাধারণ আক্রমণ ছিল না। এটি ছিল পেশাদার খুনিদের কাজ, যাদের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট এবং মারাত্মক।
হামলাকারীরা সশস্ত্র ছিল এবং তাকে তাড়া করতে শুরু করে। রাজু দৌড়াতে থাকে, কিন্তু পিছন থেকে গুলি তাকে তাড়া করতে থাকে। প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যু কাছে এসে পৌঁছায়। অবশেষে, গুলিবিদ্ধ অবস্থায়, সে রাস্তায় পড়ে যায়। খবর শুনে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো তার সঙ্গী এবং সমর্থকরা তাকে তুলে হাসপাতালের দিকে দৌড়ে যায়। কিন্তু আক্রমণকারীরা এখানেও থামেনি; তারা আবার গুলি চালাতে শুরু করে। হাসপাতাল পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এই ধাওয়া চলতে থাকে। তারা যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তা রক্তে ভেসে যায়।
হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই রাজু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে, প্রকাশ্য দিবালোকে, জনগণের নির্বাচিত বিধায়ককে রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এলাহাবাদে ভয়, ক্ষোভ এবং হতবাকের ঢেউ বয়ে যায়। সংবাদপত্রের শিরোনাম, টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ, সর্বত্র কেবল একটিই প্রশ্ন ছিল, “এখনে কেউ কি নিরাপদ?” এই হত্যাকাণ্ড কেবল একজন মানুষের ছিল না, বরং এটি ছিল গণতন্ত্রের প্রকাশ্য হত্যা।
পর্দার আড়ালে খেলা
তদন্তে জানা গেছে যে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের ব্যক্তি ছিলেন সেই সময়ের কুখ্যাত গ্যাংস্টার এবং ফুলপুরের সাংসদ আতিক আহমেদ। তার দোসররা এই ষড়যন্ত্রটি তৈরি করেছিল এবং পেশাদার শ্যুটারদের দ্বারা এটি কার্যকর করেছিল। কারণ ছিল তার রাজনৈতিক উত্থান এবং আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ। রাজু পালের জনপ্রিয়তা এবং জনগণের সাথে সরাসরি সংযোগ আতিকের সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি ছিল। এই হত্যাকাণ্ড কেবল একজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল করার জন্য ছিল না, বরং ভয়ের সাম্রাজ্য বজায় রাখার জন্য একটি বার্তা ছিল।
রাজনৈতিক উত্থান
রাজু পালের হত্যার পর রাজ্যের রাজনীতিতে এক অস্থিরতা দেখা দেয়। বিরোধীরা সরকারকে ঘিরে ফেলে, জনতা রাস্তায় নেমে আসে। এলাহাবাদের রাস্তা পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীতে ভরে যায়। কিন্তু ভয়ের ছায়া এতটাই গভীর ছিল যে কেউ সাক্ষী হতে প্রস্তুত ছিল না। এই একটি ঘটনা উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে মুলায়েম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টির পেশী আস্ফালনের বিষয়টিকে কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। পরিতাপের বিষয় হল যে আজ তার ছেলে অখিলেশ যাদব কথিত গনতন্ত্র রক্ষায় রাহুল গান্ধীর প্রধান অস্ত্র হয়ে গেছে । এদিকে যোগী আদিত্যনাথের জমানায় আতিক আহমেদের সন্ত্রাসের রাজত্বও শেষ । তার কবর আড়াল পড়ে গেছে আগাছায় ।।