এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,১৭ আগস্ট : শনিবার কলকাতার একটি অভিজাত হোটেলে বিবেক অগ্নিহোত্রীর সিনেমা ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’-এর ট্রেলার লঞ্চ অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে আসে পুলিশ । প্রথমে হোটেল কর্তৃপক্ষের তরফে বাধা দেওয়া হয়। তারপর পুলিশ এসে বন্ধ করে দেয় ট্রেলার লঞ্চ। তীব্র প্রতিবাদ জানান বিবেক বিবেক অগ্নিহোত্রী। সেই মুহূর্তের ভিডিও তিনি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট করেছেন । উপস্থিত পুলিশ আধিকারিকের উদ্দেশ্যে পরিচালককে বলতে শোনা গেছে,’সকালেই কেন আমাদের বাধা দিলেন না ? আপনি আমাকে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখাতে আসবেন না । রাজনৈতিক চাপে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’-এর ট্রেলার চলার সময় পুলিশ এসে বন্ধ করে দিয়েছে । তার কেটে দিয়েছে । রাজনৈতিক লোকেরা কেন এখানে এসেছে ? একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার মুখ কেন বন্ধ করা হচ্ছে ? ভারত বিভাজনের উপর ছবি তৈরি হয়েছে, তারপরও কেন এই ছবি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে ? আজ ১৬ আগস্ট,আজ ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ । আর আজ কেন আমাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে ।’ তিনি পুলিশ আধিকারিককে বলেন,’আপনি যে কাজটা করছেন সেটা বেআইনি ।’
https://twitter.com/vivekagnihotri/status/1956690336828592630?t=MGCi08kECTSb27qyyfhIXg&s=19
অন্যদিকে তৃণমূলের দাবি যে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ হল একটা অপপ্রচারমূলক চলচ্চিত্র । তৃণমূলের মুখপাত্র তন্ময় ঘোষ টিভি চ্যানেলের কাছে বলেছেন,’বিজেপি বকলমে এই ধরনের অপপ্রচার মূলক ছবি প্রচার করছে । ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ এর মাধ্যমে ইতিহাসকে সম্পূর্ণ বিকৃত করে বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়া হচ্ছে । বাংলার মানুষ এখানে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ চলতে দেবে না। আরও বিক্ষোভ হবে । ওদের মাথায় রাখা উচিত যে কোন মাটিতে দাঁড়িয়ে ফিল্ম বানিয়েছেন ।’
কিন্তু সত্যিই কি অপপ্রচারমূলক এই ছবিটি ?
ডাইরেক্ট একশান ডে সম্পর্কে “১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গা” শীর্ষক প্রতিবেদনে ২০০৭ সালের ৫ নভেম্বর, মার্কোভিটস ক্লদ লিখেছলেন,১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গা, যা “গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং” নামেও পরিচিত, ছিল ভারতের বাংলার রাজধানীতে চার দিনের বিশাল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, যার ফলে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ জন নিহত এবং প্রায় ১৫,০০০ জন আহত হন। এই দাঙ্গাগুলি সম্ভবত ১৯৪৬-৪৭ সময়কালের সবচেয়ে কুখ্যাত একক গণহত্যা ।’ যদিও এই ইংরেজ লেখক তাদের এজেন্ডা অনুযায়ী হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়কেই এই ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন । ডাইরেক্ট একশান ডে-এর ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী যুগল চন্দ্র ঘোষ বর্ণনা করেছিলেন যে তিনি মৃতদেহ বোঝাই চারটি ট্রাক তিন ফুট উঁচুতে স্তূপীকৃত দেখেছেন, যার রক্ত এবং মস্তিষ্ক থেকে ঝরঝর করে বেরিয়ে আসছে ।
আসলে,১৯৪৬ সালের ১৬ অগাস্ট, ভারতের ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায় হল দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস । এই দিনে, কলকাতা ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখেছিল যা চার দিন স্থায়ী হয়েছিল এবং ১০,০০০ জন প্রাণ হারিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং হত্যাকাণ্ড, কলকাতার ইতিহাসে এমন এক ঘটনা, ইতিহাসবিদ সুরঞ্জন দাস যাকে বাংলা ‘ভাগের দাঙ্গা’ সূচনা বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি লিখেছেন,১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অগাস্টের ভোরে পাকিস্তান তৈরির জন্য মুসলিম লিগ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিলে শহর কলকাতা জুড়ে শুরু হয়ে যায় হিন্দু গণহত্যা। নেহেরু তখন দিল্লিতে অন্তর্বর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী। আর অখণ্ড বাংলার শাসনের দায়িত্ব পেয়েছিল মুসলিম লিগ এবং মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সুরাবর্দি। সুরাবর্দির নির্দেশেই কলকাতায় শুরু হয় এই হিন্দু গণহত্যা। কলকাতায় ছিল মহড়া, আর পুরো উদ্দেশ্যটি কার্যকর করা হয় নোয়াখালীতে। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ৩১.৭০ শতাংশ ছিল বাইরের রাজ্য থেকে আসা এবং ৩০ শতাংশ ছিল কলকাতার বাইরের জেলাগুলি থেকে আসা লোকজন। ৬০ লক্ষ মানুষের বাস কলকাতায় ছিল ১২০০ জনের পুলিশ বাহিনী, এর মধ্যে মুসলমান ৬৩ জন। এছাড়া ডেপুটি কমিশনার ও একজন ও.সি ছিলেন মুসলমান। মুসলমান দাঙ্গাবাজদের বেশির ভাগ ছিল গ্রাম থেকে আসা লোক। এর মধ্যে ছিল মুসলমান শ্রমিক, কষাই, খালাসি, ছ্যাকড়া গাড়ির চালক। অন্যদিকে, মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে ভূমিকা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষিত যুবক, ছাত্র সমাজ ও মধ্যবিত্তদের। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্টের সকালে মুসলিম লিগ যখন অ্যাকশান শুরু করে, তখনও পর্যন্ত কলকাতার হিন্দুরা বিষয়টা বুঝে উঠতে পারেনি। কারণ, ওই দিন বিকেলে কলকাতার তথাকথিত প্রগতিশীল “ধর্মনিরপেক্ষ” হিন্দুরা ময়দানে মনুমেন্টের তলায় মুসলিম লিগ ও ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির যৌথ মিটিং শুনতে গিয়েছিল।
১৯৪৬ সালে মুসলিম লিগের নেতৃত্বে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ শুরু হলে রুখে দাঁড়ান গোপাল মুখোপাধ্যায় ও তাঁর ভারতীয় জাতীয় বাহিনী। মূলত একার হাতেই সেদিন কলকাতাকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। প্রবাদ হয়ে গিয়েছে গোপাল ছিলেন বলে টালা ট্যাঙ্ক আছে, শিয়ালদা স্টেশন আছে, আপনি, আমি রয়েছি। আর সেই প্রবাদের সঙ্গে জড়িয়ে আজও রয়েছে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উল্টোদিকে এক চিলতে মাংসের দোকান। প্রসঙ্গত ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ‘ গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ রুখে ছিলেন যিনি সেই গোপাল মুখোপাধ্যায়েরও পাঁঠার মাংসের দোকান ছিল। যে কারণে গোপাল পাঁঠা নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
ভারতের বামপন্থী, কংগ্রেস, ব্রিটিশ ও মুসলিম সম্প্রদায় পাকিস্তানি ব্যারিস্টার, রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রনায়ক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যে বাংলার কসাই নামেও পরিচিত, তার নৃশংসতাকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে এবং আজও যাচ্ছে । তারা হিন্দুদের ত্রাতা,যিনি একা হাতে সোহরাওয়ার্দীর সৃষ্টি দাঙ্গা রুখে দিয়েছিলেন,সেই শ্রদ্ধেয় গোপাল মুখোপাধ্যায়ের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে যায় । যে কাজটা হয়ত এরাজ্যের বর্তমান শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসও চালিয়ে যেতে চাইছে ভোট ব্যাংকের স্বার্থে । তবে তৃণমূল কংগ্রেস যতই ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’কে অপপ্রচারমূলক ছবি বলে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া হিন্দু নরসংহারের অগণিত লিখিত প্রমাণ এখনো আছে । বিজেপির অভিযোগ যে শুধুমাত্র মুসলিম ভোট ব্যাংকে সন্তুষ্ট করতে তৃণমূল এই ছবিটির বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে দিয়েছে । গতকাল বিকেলে ‘১৯৪৬ দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’, হিন্দু গণহত্যার স্মরণে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী । তার সঙ্গে বহু সাধুসন্ত উপস্থিত ছিলেন । পদযাত্রা শেষে তিনি একটি পথসভায় বক্তব্য রাখেন । কোন একটি পাঠ্যপুস্তক থেকে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় ঘটে যাওয়া হিন্দু নরসংহারের বিবরণ পড়ে শোনান । শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘প্রথম হামলা ঘটে ভোর ৪:৩০ নাগাদ । প্রথম নিহত হয় এক হিন্দু । সেই থেকে শুরু হয়ে চলে ১৮ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত । একজন হিন্দু বাদ যায়নি । অভিনেতা ছবি বিশ্বাস, গনিতজ্ঞ যাদব চক্রবর্তী, কেউ বাদ যাননি । হিন্দু পুলিশ থেকে হিন্দু ছাত্র কেউ বাদ যায়নি । ধর্মতলা রোডের বিখ্যাত কমলালয় স্টোর থেকে লোয়ার সার্কুলার রোডের লক্ষীকান্ত দাসের সাইকেলের দোকান কেউ বাদ যায়নি । রাজা বীরেন্দ্র স্ট্রীটের এর প্রায় সমস্ত হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পলাশীর যুদ্ধের থেকেও বেশি হিন্দুর মৃত্যু হয় ওইদিন । কারণ সকলেই হিন্দু ছিলেন।’
ত্রিপুরার প্রাক্তন রাজ্যপাল এবং হিন্দুত্ববাদী লেখক তথাগত রায় এক্স-এ একটি ভিডিও পোস্ট করে লিখেছেন, নোয়াখালি বেগমগঞ্জের প্রাক্তনী ৯৪ বছর বয়স্ক রবীন্দ্রনাথ দত্ত আজও লড়াই করে যাচ্ছেন – হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে, এবং ভোটের লোভে সেটা লুকিয়ে রাখার বিরুদ্ধে।’ রবীন্দ্রনাথ দত্তকে বলতে শোনা গেছে, ‘১৯৪৬ সালের “ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে” এর সময় রাজাবাজারের গরুর মাংসের দোকানের সামনে মেয়েদের উলঙ্গ হাত-পা কাটা ডেড বডি মাথায় হুক দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিল । সেটা পুলিশের অফিসাররা আমায় নিজে বলেছে । ভিক্টোরিয়া কলেজের হোস্টেলে মেয়েদেরকে ধর্ষণ করে মেরে জানালার সাথে ঝুলিয়ে রেখেছিল ।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘এখন বাঙালিরা সে সব ভুলে গেছে ।’
বিজেপির সর্বভারতীয় আইটি ইনচার্জ অমিত মালব্য ছবিটির ট্রেলার এক্স-এ পোস্ট করে লিখেছেন,’আজ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে, কলকাতায় দ্য বেঙ্গল ফাইলস- এর ট্রেলার লঞ্চ বন্ধ করা হয়েছে। এটি দেখুন, এবং নিশ্চিত করুন যে এটি বাংলার প্রতিটি ঘরে যেন পৌঁছে যায় । প্রতিটি হিন্দুর এটি দেখা উচিত। আমরা পশ্চিমবঙ্গকে আরেকটি বাংলাদেশে পরিণত হতে দিতে পারি না।’ গতকাল “দ্য বেঙ্গল ফাইলস”-এর ট্রেলার মুক্তি কলকাতা পুলিশ আজকে দেয়ার পর ছবির অন্যতম অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী কষ্ট করে দিয়েছেন যে ছবিটি রিলিজ হবেই ।
তবে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের কোন ছবির বিরুদ্ধাচারণ করার ঘটনা এই প্রথম নয় । এর আগে গত ৫ মে সুদীপ্ত সেন পরিচালিত দ্য কেরালা স্টোরি সিনেমাটি এরাজ্যে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি । সিনেমাটি ছিল আন্তর্জাতিক ইসলামিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির দ্বারা কেরালায় ‘লাভ জিহাদ’ চালানোর ঘটনা অবলম্বনে । তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বক্তব্য ছিল, সিনেমাটি প্রদর্শিত হলে, তা ‘শান্তিভঙ্গের কারণ হতে পারে’ এবং ‘রাজ্যের শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য এবং হিংসা ও অশান্তির ঘটনা এড়াতে’ এটি দরকার ছিল। যদিও সিনেমাটি বক্স অফিসে ব্যাপক সাফল্য পায় ।।