স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে তোষামোদের রাজনীতির প্রথম সূচনা করে গেছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং তার সাগরেদ জহরলাল নেহেরু । দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়ার পরেও গান্ধী এবং নেহেরুর ইচ্ছাতে বিপুল সংখ্যক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতের থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিল । সেই দেশভাগের কালো অধ্যায়ের সময়ে কিভাবে গান্ধী ও নেহেরু মিলে ভারতীয় মুসলিমদের আটকে রেখে কিভাবে পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন পাকিস্তানি- সুইডিশ লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইশতিয়াক আহমেদ। তার কথায় যদি ৩.৫ কোটি ভারতীয় মুসলমান পাকিস্তানি আসতো তাহলে পাকিস্তানের অর্থ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যেত । গান্ধী এবং নেহেরু মিলে তা রুখে দিয়ে পাকিস্তানের জাতির জনক মহম্মদ আলী জিন্নাহকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন বলে তিনি মনে করেন ।
একটা সাক্ষাৎকারে ইশতিয়াক আহমেদের এই বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপটি পাকিস্তান আনটোল্ড নামে এক্স হ্যান্ডেলে ভারতের ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগে ভাইরাল হয় । ইশতিয়াক আহমেদ দাবি করছেন যে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় গান্ধী এবং জওহরলাল নেহেরু কেবল পাকিস্তানকে রক্ষা করেননি, এমনকি গান্ধীও তার জন্য যা কিছু করণীয় সবকিছু করেছিলেন ।
ভিডিওতে আহমেদ বলছেন যে গান্ধী এবং নেহেরু হস্তক্ষেপ না করলে প্রায় ৩.৫ কোটি মুসলিম ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেত, যার কারণে নবগঠিত পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়তে পারত কারণ সেই সময়ে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩.৩৯ কোটি এবং পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে লেখার জন্য কাগজপত্রও ছিল না, সম্পদের কথা তো দূরের কথা। তিনি বলেছেন যে গান্ধী দিল্লিতে দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য আমরণ অনশন করেছিলেন এবং মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন, অন্যদিকে নেহেরু আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার মতো বাহিনীকে জোর করে মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়া থেকে বিরত রেখেছিলেন। এই কারণে, কোটি কোটি মুসলমান ভারতেই থেকে গেছে ।
আহমেদ আরও বলেন যে জিন্নাহ নিজে চাননি যে ভারতীয় মুসলিমরা পাকিস্তানে আসুক, বরং তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দু এবং শিখরা ভারতে চলে যাক, কিন্তু পাকিস্তান তাদের সেখানে থাকতে দেয়নি এবং জোরপূর্বক বহিষ্কার করে, যার ফলে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখা দেয়, বিশেষ করে পাঞ্জাব, সিন্ধু এবং বাংলার মতো অঞ্চলে।
আহমেদ আরও বলেন যে বিহার থেকে প্রায় ৫০ লক্ষ মুসলিম পূর্ব পাকিস্তানে, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে চলে গিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় ৩ কোটি মুসলিম ভারতেই থেকে গেছে, যা গান্ধী ও নেহরুর ইচ্ছা ছাড়া সম্ভব ছিল না।
তিনি বলেন যে, এই ৩ কোটি মানুষও যদি পাকিস্তানে চলে যেত, তাহলে দেশটি একটি গুরুতর জনসংখ্যা সংকটে আটকা পড়ত এবং সম্ভবত ভেঙে পড়ত। আহমেদ ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরের কথাও উল্লেখ করেন, যিনি সেই সময় জনসংখ্যার সম্পূর্ণ বিনিময়ের পক্ষে ছিলেন এবং সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে যদি এটি না ঘটে, তাহলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। আহমেদ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে গান্ধী ও নেহেরু যা করেছিলেন, তা কেবল ভারতের মুসলমানদের নিরাপত্তাই প্রদান করেনি, বরং পাকিস্তানকে সেই সময়ের সবচেয়ে বড় মানবিক ও প্রশাসনিক বিপর্যয় থেকেও রক্ষা করেছিল।
গান্ধী ও নেহেরু পাকিস্তানকে বাঁচিয়েছিলেন, কিন্তু ভারতকে সাম্প্রদায়িক ক্ষত দিয়ে রেখেছিলেন
ইশতিয়াক আহমেদের এই মন্তব্য এমন এক বিড়ম্বনার কথা তুলে ধরে যা ইতিহাসে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়েছে । সাধারণত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গল্পটি গান্ধী, নেহেরু এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, কিন্তু এই ভিডিওতে একজন পাকিস্তানি পণ্ডিত নিজেই স্বীকার করেছেন যে যদি গান্ধী এবং নেহেরু ১৯৪৭ সালে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে পাকিস্তান তার শুরুতেই ভেঙে যেতে পারত।
গান্ধী এবং নেহেরু সেই সময় ভারতে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে পাকিস্তানে যেতে বাধা দিয়েছিলেন। যদি এই সমস্ত মুসলিম পাকিস্তানে চলে যেত, তাহলে পাকিস্তান এত বিশাল জনসংখ্যার বোঝায় ভারাক্রান্ত হত যে জিন্নাহ তা সামলাতে পারত না। সেই সময় পাকিস্তানের কাছে প্রয়োজনীয় সম্পদ ছিল না, প্রশাসনিক কাঠামোও ছিল না, এমনকি এত বিপুল সংখ্যক মুসলিমকে সামলানোর মতো পরিস্থিতিও ছিল না। ভারতের মুসলমানদের এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে, ভারতের নেতারা একরকমভাবে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছিলেন এবং এর জনসংখ্যার ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন। অন্যদিকে, পাকিস্তানের হিন্দু এবং শিখদের জোরপূর্বক বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে হিংসা চালানো হয়েছিল এবং তাদের সেখানে থাকতে দেওয়া হয়নি।
আজ, পাকিস্তানের সরকারী ইতিহাসে, এটি খুব কমই স্বীকার করা হয় যে এর প্রাথমিক অস্তিত্বও ভারতের সংযম এবং গান্ধী-নেহরুর নীতির সাথে যুক্ত ছিল। সেখানে, দেশভাগকে সম্পূর্ণরূপে জিন্নাহর দূরদর্শিতা এবং বিজয় হিসাবে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে, ভারতেও এই সত্যটি খুব বেশি আলোচনা করা হয় না। স্বাধীনতা-পরবর্তী অনেক সরকার গান্ধী এবং নেহেরুকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে তুলে ধরেছিল, কিন্তু এই বিষয়টির প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়নি যে ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরের কথা অনুসারে যদি ‘সাম্প্রদায়িক সমস্যা’ সেই সময়ে সম্পূর্ণরূপে সমাধান করা হত, তাহলে সম্ভবত ৮০ বছর পরেও আজও এই সমস্যাটি দেশকে সমস্যায় ফেলত না। এইভাবে, এই পুরো গল্পটি আমাদের দেখায় যে ইতিহাস কেবল দ্বিমুখী নয়, বরং এর অনেক দিক রয়েছে, যা বোঝা এবং গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং জহরলাল নেহেরুর প্রকৃত মূল্যায়ন খুবই দরকার হয়ে পড়েছে সমসাময়িক কালে ।।