ভূমিকা :
পূর্ব বর্ধমান জেলা, পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে স্থান পেয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই জেলার মানুষ রাজনৈতিক আন্দোলন, বিপ্লবী কার্যকলাপ, সামাজিক সংস্কার এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত, প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে এ অঞ্চলের জনমানসে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থান, সামাজিক গঠন, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং শিক্ষার বিস্তার—সবই পূর্ব বর্ধমানের আন্দোলনের চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল দেশপ্রেমের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষাবিস্তার বর্ধমান ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে স্বদেশী ভাবনার বিকাশ ঘটায়। ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত সভা’, ‘স্বদেশী সমিতি’ এবং অন্যান্য সংগঠন রাজনৈতিক সচেতনতার ভিত্তি তৈরি করে। কালনায় উপেন্দ্রনাথ সেন ও দেবেন্দ্রনাথ সেন-এর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী সভা, কাজী নজরুল ইসলামের দেশাত্মবোধক গান, এবং গ্রাম-শহরে বিপ্লবী চেতনার বিস্তার—সবই পূর্ব বর্ধমানকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মানচিত্রে সুদৃঢ়ভাবে চিহ্নিত করে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ভৌগোলিক অবস্থান :
পূর্ব বর্ধমান জেলার অবস্থান রাঢ়বঙ্গ ও গঙ্গা সমভূমির সংযোগস্থলে, যা একদিকে কৃষি উৎপাদনে সমৃদ্ধ, অন্যদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় সুবিধাজনক। ১৮৫৪ সালে হাওড়া-রানীগঞ্জ রেলপথ চালু হওয়ার পর বর্ধমান শহর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই অবস্থানই পরবর্তী সময়ে স্বদেশী ও বিপ্লবী আন্দোলনের বার্তা দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন (১৯০৫–১৯১১)
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্ত কেবল প্রশাসনিক পুনর্গঠন নয়, বরং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এক মোড় পরিবর্তনের ঘটনা ছিল। পূর্ব বর্ধমান জেলা তৎকালীন বৃহত্তর বর্ধমান জেলার অংশ হিসেবে কলকাতার মতোই এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক সচেতনতার বিস্তার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রেক্ষাপটে, বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলে।
স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাবে জেলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, যেখানে ব্রিটিশ শিক্ষা-নীতির বিকল্প দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়। বর্ধমান রাজ কলেজ, কালনা হাই স্কুল এবং মেমারি হাই স্কুল স্বদেশী আদর্শ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছাত্র ও তরুণরা গোপনে বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লিফলেট বিতরণ, তহবিল সংগ্রহ, এবংবিদেশি পণ্যের বর্জন কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ শহর থেকে গ্রামে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কৃষক ও হস্তশিল্পীরা বিদেশি কাপড় পোড়ানোর অনুষ্ঠান, ব্রিটিশ পণ্যের বর্জন, এবং দেশীয় বস্ত্র ব্যবহারে অংশ নেন। ১৯০৬ সালের শুরুতে কালনা ও বর্ধমান শহরে একাধিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বক্তৃতা দেন প্রখ্যাত নেতারা—যেমন বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ এবং প্রীতিলতা দেবী।
চুরুলিয়ার কবি কাজি নজরুল ইসলাম, যদিও সে সময় কিশোর, পরে তার দেশাত্মবোধক গান ও কবিতায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের চেতনা ও ত্যাগের অনুরণন তুলে ধরেন। স্বদেশী গান, নাটক ও কবিতার মাধ্যমে স্বাধীনতার আগুন শুধু শহরে নয়, পূর্ব বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে।
এই সময়ে গড়ে ওঠা বিপ্লবী চেতনা ১৯১২ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পরেও নিভে যায়নি; বরং তা পরবর্তী দশকে অসহযোগ আন্দোলন ও সশস্ত্র বিপ্লবের ভিত্তি তৈরি করে।
অসহযোগ ও স্বদেশী আন্দোলন (১৯১৯–১৯৩০)
১৯১৯ সালের রওলাট আইন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (১৩ এপ্রিল ১৯১৯) সমগ্র দেশের মতো পূর্ব বর্ধমান জেলার রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও উত্তপ্ত করে তোলে। জাতীয়তাবাদী নেতা মহাত্মা গান্ধি ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে জেলার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশ নেন।
বর্ধমান শহর ও কালনা, মেমারি, মন্তেশ্বর, কাটোয়া প্রভৃতি অঞ্চলে কংগ্রেস কমিটি গঠন হয়। বর্ধমান রাজ কলেজ ও স্থানীয় বিদ্যালয়গুলির শিক্ষার্থীরা সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন করে জাতীয় বিদ্যালয় ও স্বদেশী শিক্ষা কেন্দ্র-এ যোগ দেন। সরকারি চাকরি, আইন আদালত এবং বিদেশি দ্রব্য বর্জনের ডাক জেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষিজীবী গ্রামাঞ্চলেও রাজনৈতিক সভা, মিছিল ও স্বদেশী প্রচারণা জোরদার হয়।
স্থানীয় নেতৃত্বে ছিলেন কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্ল কুমার মুখোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ। তারা গান্ধিজির চরকা আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তুলতে গ্রামাঞ্চলে চরকা ও খদ্দরের প্রচার চালান। অনেক গ্রামে খদ্দর পরিধান দেশপ্রেমের প্রতীক হয়ে ওঠে।
তবে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ প্রশাসনও দমননীতি জোরদার করে। বহু নেতা ও কর্মী গ্রেপ্তার হন, সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করা হয়, এবং কংগ্রেস কার্যালয়গুলিতে তল্লাশি চালানো হয়। বিশেষ করে ১৯২১ সালের শেষ দিকে এবং ১৯২২ সালের শুরুতে সরকারি দমননীতি আন্দোলনের গতি মন্থর করে দেয়। তবুও পূর্ব বর্ধমানের মানুষ এই আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগ্রামে নিজেদের দৃঢ় অঙ্গীকার প্রদর্শন করেন।
১৯৩০ সালের লবণ সত্যাগ্রহেও জেলার বহু কর্মী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক প্রভাব বর্ধমানের তরুণ প্রজন্মকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। নদীয়া ও মুর্শিদাবাদের আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ব বর্ধমানের রাজনৈতিক যোগাযোগও সুদৃঢ় হয়, যা জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
বিপ্লবী সংগঠন ও গোপন কার্যকলাপ
পূর্ব বর্ধমান জেলার যুবসমাজের মধ্যে ২০শ শতকের প্রথম দুই দশকে যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতি-র প্রভাব ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী। এ দুটি সংগঠন কলকাতা থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও, জেলার বিভিন্ন প্রান্তে তাদের গোপন শাখা সক্রিয় ছিল। রাসবিহারী বসু, বটুকেশ্বর দত্ত, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ নেতার সঙ্গে জেলার বিপ্লবীদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের নথি পাওয়া যায়। অস্ত্র সংগ্রহ, বিস্ফোরক প্রস্তুতি, গোপন শারীরিক প্রশিক্ষণ এবং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা—সবক্ষেত্রেই পূর্ব বর্ধমানের তরুণ বিপ্লবীরা অংশ নেন।
১৯১৫ সালের গদর ষড়যন্ত্র মামলায় বর্ধমান জেলার বিপ্লবীদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়, যা প্রমাণ করে যে এই অঞ্চল আন্তর্জাতিক বিপ্লবী নেটওয়ার্কের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। এই সময়ে জ্যোতিন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি পরবর্তীতে ‘নিরালম্ব স্বামী’ নামে পরিচিত হন, তরুণ বয়সেই সক্রিয় বিপ্লবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
জেলার রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধিতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত ভারত সভা বিশেষ অবদান রাখে। এর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা—বর্ধমান শাখা, কালনা শাখা এবং পূর্বস্থলী হিতকরী সভা—দেশপ্রেমিক যুবকদের সংগঠিত করে। ১৯০৬ সালে কালনার কবিরাজ বংশের উপেন্দ্রনাথ সেন ও দেবেন্দ্রনাথ সেনের উদ্যোগে আয়োজিত বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী সভায় সুরেন্দ্রনাথ স্বয়ং উপস্থিত থেকে ব্রিটিশবিরোধী বক্তৃতা প্রদান করেন।
একই বছর কালনার বাঘনা পাড়ায় বিদেশি দ্রব্য লুঠ ও দহন আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এই ঘটনায় ব্রিটিশ পুলিশ দমননীতির আশ্রয় নেয়, এবং এটি বঙ্গের অন্যতম প্রথম রাজনৈতিক মোকদ্দমায় রূপ নেয়। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে যে, পূর্ব বর্ধমান কেবল সাংস্কৃতিক নয়, বরং সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২)
১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট বোম্বাইয়ে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধি “করো বা মরো” (Do or Die) স্লোগান দিয়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা করেন। এই ঘোষণার পরপরই সারা দেশে, বিশেষ করে গ্রামীণ বাংলায়, অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। পূর্ব বর্ধমান জেলার গ্রামাঞ্চলও এই আন্দোলনের আগুনে দগ্ধ হয়।
ভাতার, গলসি, মঙ্গলকোট, আউশগ্রাম, কাটোয়া ও কালনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রসমাজ সক্রিয়ভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সরকারি অফিস দখল, রেলপথ ও টেলিগ্রাফ লাইন কেটে দেওয়া, ডাকঘর ও থানায় আক্রমণ, এবং প্রশাসনিক নথিপত্র ধ্বংস—এসব ছিল তাদের প্রতিবাদের উপায়। এইসব কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের যোগাযোগ ও প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে দেওয়া, যাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে।
পুলিশ ও সেনাবাহিনী দ্রুত কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীকে গ্রেপ্তার, লাঠিচার্জ এবং বন্দুক চালিয়ে দমন করা হয়। এই সময় ভাতারের সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলকোটের হেমন্তকুমার দত্ত, এবং কাটোয়ার প্রফুল্ল চক্রবর্তী-র মতো স্থানীয় নেতা ও কর্মীরা নেতৃত্ব দেন। অনেকেই ব্রিটিশদের হাতে গুরুতর আহত হন, কেউ কেউ প্রাণ হারান।
যদিও আন্দোলনটি সশস্ত্র দমন ও গ্রেপ্তারের ফলে ১৯৪৩ সালের শুরুর দিকে দুর্বল হয়ে পড়ে, তবুও এর প্রভাব পূর্ব বর্ধমানের জনজীবনে গভীরভাবে স্থায়ী হয়। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন, স্বাধীনতা আর দূরে নয়। কৃষক-শ্রমিকদের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তী কালে স্বাধীনতা-উত্তর সামাজিক পরিবর্তনের ভিত্তি স্থাপন করে।
জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন ও সামাজিক জাগরণ
স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি পূর্ব বর্ধমানে শিক্ষা ও সমাজসংস্কারের প্রচেষ্টাও চলছিল। জাতীয় বিদ্যালয়, পাঠাগার এবং নাট্যদলের মাধ্যমে স্বাধীনতার বার্তা প্রচারিত হতো। ইংরেজি বিদ্যালয়ের বিকল্প হিসেবে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে বর্ধমান জেলার ভূমিকা ছিল অনন্য। খণ্ডঘোষের তোরকোনা গ্রামের রাসবিহারী ঘোষ জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিপুল অর্থদান করেছিলেন। কালনা, বর্ধমান সদর ও বৈকুণ্ঠপুরে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। একই সঙ্গে ‘বান্ধব সমিতি’, ‘মহামায়া সমিতি’সহ বিভিন্ন গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিল।
জাতীয় আন্দোলন ও নারী অংশগ্রহণ
নারী অংশগ্রহণও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—গৃহবধূ, ছাত্রী ও শিক্ষিত মহিলারা সভা সংগঠিত, বার্তা বহন ও আহত বিপ্লবীদের সেবা করতেন । বর্ধমানের সুরমা মুখোপাধ্যায় ও নির্মলা সান্যালসহ অনেক নারী স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। তাঁরা শুধু সভা-সমিতিতে নয়, বিপ্লবী বার্তা প্রচার ও গোপন সহায়তায়ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কৃষক আন্দোলন ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত
১৯৩০-এর দশকের গোড়ায় স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি পূর্ব বর্ধমান জেলায় কৃষক আন্দোলনেরও নতুন ধারা গড়ে ওঠে। ১৯৩১ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত “ বর্ধমান জেলা কৃষক সমিতি” জেলার কৃষিজীবী জনতার মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও অধিকারবোধ জাগিয়ে তোলে। জমিদারি প্রথা, মহাজনি শোষণ ও অত্যধিক খাজনার বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এই সমিতির জন্ম হয়। সমিতির প্রথম সভার সভাপতি ছিলেন বিশিষ্ট বিপ্লবী ও মার্কসবাদী চিন্তাবিদ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত যার স্মৃতিতে আজও হাটগোবিন্দপুরে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি মহাবিদ্যালয় রয়েছে।
ঐতিহাসিক গুরুত্বের মূল্যায়ন
পূর্ব বর্ধমান জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান ভারতীয় জাতীয় ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। এই জেলার বিপ্লবীরা কেবল স্থানীয় পর্যায়ে নয়, বরং সর্বভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারা ও কৌশলে প্রভাব ফেলেছিলেন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে বর্ধমানের মানুষ স্বদেশী, অসহযোগ, সশস্ত্র বিপ্লব এবং কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। রাসবিহারী বসুর আন্তর্জাতিক বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, বটুকেশ্বর দত্তের বিপ্লবী সাহস, এবং স্থানীয় স্তরে অসংখ্য অজ্ঞাতনামা যোদ্ধার আত্মত্যাগ ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল।
এছাড়া, শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রস্তুতিকে শক্তিশালী করা — যেমন জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বিদেশি পণ্যের বর্জন, নারীশিক্ষার প্রসার — ছিল এই জেলার আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বর্ধমানের সংগ্রামী ঐতিহ্য কেবল রাজনৈতিক মুক্তির স্বপ্নই নয়, সামাজিক ন্যায় ও আত্মনির্ভরতার আদর্শও বহন করেছে। আজকের প্রজন্মের জন্য এই ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার কেবল গৌরবের স্মারক নয়, বরং নাগরিক কর্তব্য ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার অনুপ্রেরণার উৎস।।