দিব্যেন্দু রায়,ভাতার(পূর্ব বর্ধমান),১৫ আগস্ট : তখন সবে অন্ধকার নেমেছে ৷ স্বামীর বাইকের পিছনে চড়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে নামলেন মধ্য বয়সী এক বধূ । তাঁকে দেখে ছুটে এলো আশপাশের পথ কুকুরের দল । বধূ তাঁর স্বামীর বাইকে ঝোলানো একটা বড়সড় ব্যাগ থেকে মাঝারি আকারের স্টিলের বাটি বের করে কুকুরগুলির সামনে রেখে দিলেন । এরপর একটি বড় স্টিলের কৌটো থেকে মশলাবিহীন মাংসের ঝোল মাখা ভাত পরিবেশন করলেন কুকুরগুলিকে । পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার বাজারের বাসিন্দা টুম্পা রায় (৪৬) ও বিশ্বজিৎ রায় (৬২) নামে ওই দম্পতির এটা রোজনামচা হয়ে গেছে । কোনো সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এলাকার পথ কুকুরদের দু’বেলার খাবার ও চিকিৎসার খরচ জুটিয়ে যাচ্ছেন পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার বাজারের এই দম্পতি ।
ভাতার বাজারের রামকৃষ্ণ পল্লি এলাকায় বাড়ি বিশ্বজিৎ রায় ও টুম্পা রায় নামে ওই দম্পতির । বর্ধমান- কাটোয়া রাজ্য সড়কপথের ধারেই দু’তলা বাড়িতে বসবাস তাদের । বাড়িতে রয়েছে শুধু তাদের একমাত্র ছেলে সুরজিত । ছেলে এবছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন । সুরজিতের কলকাতার একটা কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু তার বাবা-মা দূরে পাঠানোর ঝুঁকি নেয়নি । যেকারণে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বাড়িতেই রয়ে গেছেন সুরজিত ।
জানা গেছে,গৃহবধূ টুম্পা রায়কে পশুপাখি প্রেমী বলে চেনেন এলাকার বাসিন্দারা । প্রবল গরমে পশুপাখিদের যাতে জলকষ্টে না ভুগতে হয় তাই বাড়ির বাইরের বারান্দা ও ছাদে রাখা পাত্রে নিয়মিত জল ভরে রেখে দেন তিনি । পাশাপাশি নিজের পাড়ার পথকুকুরদের দুপুর ও রাতে ডেকে ডেকে খাওয়ানোর অভ্যাস ছিল তার । তাঁর এই পশুপাখি প্রেমে প্রভাবিত হন স্বামী বিশ্বজিৎ রায় । স্ত্রীর পরামর্শ মেনে তিনি নিজ খরচে ভাতার বাজারের সমস্ত পথকুকুরদের দু’বেলা অন্ন জোটাতে উদ্যোগী হন তিনি । স্ত্রীকে বাইকে চাপিয়ে দুপুর ও রাতে ভাতার বাজার ঘুরে ঘুরে পথকুকুরদের খাইয়ে আসা রুটিন হয়ে গেছে তার । ২০১২ সাল থেকে এযাবৎ এই মানবিক উদ্যোগ নিয়ে আসছেন ওই দম্পতি।
টুম্পা রায় জানান,রোজ অন্তত ১০০ পথকুকুরকে তারা দু’বেলার খাবার সরবরাহ করেন । মেনুতে থাকে তেল মশলা ছাড়া মুরগির মাংসের ঝোল মাখা ভাত । কুকুরদের জন্য প্রতিদিন ২ কেজি মাংসের ঝোল ও ১০ কেজি চালের ভাত রান্না হয় । আর নিজের হাতেই রান্না থেকে কুকুরদের খাইয়ে আসার কাজ করেন বলে জানান তিনি । টুম্পাদেবী বলেন,’খাবার ও ওষুধ মিলে মাসে গড়ে ৩০,০০০ টাকা খরচ হয় ।’
কিন্তু কোথা থেকে আসে এত টাকা ? এর উত্তরে বিশ্বজিৎ রায় বলেন,’আমরা কোনো সরকারিভাবে সরকারি সাহায্য পাই না । নাসিগ্রামে আমার কিছু পৈত্রিক জমি আছে যেগুলিতে ভাগ চাষ করি । এছাড়া কিছু ঘর ভাড়াও পাই । পথ কুকুরদের সেবার কাজ মূলত সেই উপার্জনেই হয় ।’ তবে স্থানীয় এক রাইস মিল মালিক তাকে স্বল্প মূল্যে চাল সরবরাহ করেন বলে জানান বিশ্বজিৎবাবু ।
জানা গেছে, সম্প্রতি প্রাণীবন্ধু ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট নামে নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছেন ওই দম্পতি । কলকাতা থেকে তার রেজিস্ট্রেশনও করিয়েছেন । ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেল খুলেছেন ওই সংস্থার নামে । কিন্তু সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোন সাহায্যই তিনি এযাবৎ পাননি। এনিয়ে হতাশ বিশ্বজিৎ রায় বলেন,যতদিন পারবো এভাবেই চালিয়ে যাব,কি আর করা যাবে !’
একদিকে দিল্লিতে যখন সড়কপথগুলি পথকুকুর মুক্ত করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে । কুকুরদের বন্ধ্যাত্বকরণের জন্য সওয়াল করেছেন আইনজীবী কপিল সিব্বল । পাশাপাশি তখন অন্যদিকে ভাতারের এই পশুপাখিপ্রেমী দম্পতির মানবিক রূপ নজর কেড়েছে সকলের ।।