শিবসংহিতায় বর্ণিত খেচরী মুদ্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ হঠযোগ প্রক্রিয়া, যেখানে জিহ্বাকে পেছনের দিকে বাঁকিয়ে তালুর উপরের অংশে এবং নাসারন্ধ্রে স্পর্শ করানো হয়। এটি একটি উন্নত যোগ কৌশল যা শরীর ও মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
“খেচরী”র অর্থ হল→‘খ’ তে বিচরণ করা I →‘খ’ এর অর্থ→”আকাশ” I ”আকাশ” শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে→ ‘কাশৃ’ ধাতু থেকে I ‘কাশৃ’ ধাতু→দীপ্তো I কাজেই ”আকাশ” অর্থাৎ দীপ্তিমস্ত “ব্রহ্মতত্ত্ব”এ তা সম্ভব হয় I
ভগবান দত্তাত্রেয় বলেছেন →“কপাল বিবরের অভ্যন্তরে জিহ্বাকে ব্যবৃত্ত ও বন্ধ করে ভ্রুমধ্যে দৃষ্টি স্থাপন করবে”→এরই নাম “খেচরী” I এই হঠযোগ সম্পর্কে যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের উপলব্ধি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে হয়েছে যোগীরাজ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা “শ্যামাচরণ ক্রিয়াযোগ ও অদ্বৈতবাদ” পুস্তকে । ওই পুস্তকের খন্ডাংশ নিচে তুলে ধরা হল :
শিবসংহিতার ৫৫ শ্লোকে বলা হয়েছে –
অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্ব্বাবস্থাং গতোহপি বা।
খেচরী যস্য শুদ্ধা তু স শুদ্ধো নাত্র সংশয়ঃ।
অর্থাৎ যোগী পবিত্র অথবা অপবিত্র যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, খেচরীমুদ্রা সাধন করলে সর্ব- অবস্থাতেই শুদ্ধ থাকবেন এতে কোন সংশয় নেই। পবিত্র-অপবিত্র মনের ধর্ম। মন চঞ্চল বলেই পবিত্র- অপবিত্র বোধ হয়। কিন্তু খেচরী অবস্থায় থেকে অধিক এবং উত্তমপ্রকারে প্রাণকর্ম করতে থাকলে আপনা হতেই যখন প্রাণ স্থির হয়ে যায় তখন স্বতঃই শূন্যে স্থিতি হয়। এই প্রকারে শূন্যে মনের স্থিতি হলে মন নিরুদ্ধ হয় ও মনশূন্য অবস্থা হয়। এই মনশৃক্ত অবস্থায় মনের চাঞ্চল্য না থাকার আর মনের কর্ম থাকে না, মনের দৌড় ঝাঁপ চলে যায়। তাই শাস্ত্র বলেছেন-
শিবসংহিতার ১৫৩ শ্লোক :
করোতি রসানাং যোগী প্রবিষ্টাং বিপরীতগাম্।
লোম্বিকোর্দ্ধেষু গর্ত্তেষু কৃত্বা ধ্যানং ভয়াপহম্ ।
অর্থাৎ যে যোগী জিহ্বা বিপরীতগামী করে আলজিহ্বা উর্ধ্ব স্থিত রন্ধ্রে প্রবেশ করেন এবং সেই অবস্থায় জিহবা স্থির রেখে কুটস্থে ধ্যান করতে থাকেন তিনি জন্ম মৃত্যু প্রভৃতি সমস্ত ভয় হতে পরিত্রাণ পান। যোগিরাজ এই খেচরীমুদ্রার উপকারিতা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আরো পরিষ্কার ভাবে বলেছেন- “জিহ্বা উঠনেদে ইন্দ্রিয় দমন হোতা হয়।”
এই বিষয়ে শিবসংহিতার ৫৮ অধ্যায়ে বলা হয়েছে-
গুরূপদেশতো মুদ্রাং যো বেত্তি খেচরীমিমাম্ ।
নানাপাপরতো ধীমান স যাতি পরমাং গতিম্ ।
অর্থাৎ যে সাধক গুরুপদেশে এই খেচরীমুদ্রা জ্ঞাত হয়েছেন, তিনি যদিও মহাপাপে পাপী হন, তথাপি শ্রেষ্ঠ গতি লাভ করতে পারেন। অতএব গুরুর কর্তব্য শিষ্যকে এই বিদ্যা অবশ্যই দান করা এবং শিষ্যেরও কর্তব্য গুরুর নিকট হতে এই বিদ্যা লাভকরা। অধ্যাত্মমার্গে প্রবেশ করিতে হলে খেচরীমুদ্রা সাধন অবশ্য কর্তব্য। এই খেচরীমুদ্রা সাধনকে বলা হয় জিহ্বাগ্রন্থি ভেদ বা ব্রহ্মগ্রন্থি ভেদ যা ক্রিয়াযোগের প্রথম ক্রিয়াতেই বলা হয়েছে। অতএব গুরুগণ যদি সাধককে এই বিদ্যার পথ না দেখান এবং সাধকও যদি গুরুর নিকট হতে কেমন করে খেচরীমুদ্রা সাধন করতে হয় তা যদি জ্ঞাত না হন তবে তাতে না হয় গুরুর উপকার, না হয় শিষ্যের উপকার। কারণ এই বিদ্যা ব্যতিরেকে শিষ্য কখনই আত্মরাজ্যে সঠিকভাবে প্রবেশলাভ করতে পারে না। তাই এই বিদ্যালাভ সকল সাধকের অবশ্য কর্তব্য। খেচরীমুদ্রার মাধ্যমে অমৃতকূপ স্পর্শ করতে হলে জিহ্বা সুদীর্ঘ হওয়া আবশ্যক। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে সাধক স্বীয় জিহ্বার নিম্নন্বিত শিরা কেটে ফেলেন। পরে ঘি বা মাখন দিয়ে জিহ্বা দোহন করেন এবং মাঝে মাঝে চিমটা বা সাঁড়াশি দ্বারা টেনে জিহ্বাকে লম্বা করার চেষ্টা করেন। যোগিরাজের মতে এই প্রকারে জিহ্বাকে লম্বা করা সম্পূর্ণরূপে অনুচিত। কারণ কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে কেটে ফেললে বা বলপ্রয়োগ করলে তার স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট হয়। তাই তিনি এক বিশেষ প্রকৃয়ার মাধ্যমে, বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে যাতে সকল সাধক সহজেই খেচরী-মুদ্রা লাভ করতে পারেন তার উপায় দেখিয়েছেন। প্রকৃতির বিরুদ্ধে না গিয়ে সহজেই সকল সাধক যাতে খেচরীমুদ্রা লাভ করতে পারেন তার উপায় যোগিরাজ ব্যতীত আর কেউ দেখাতে পেরেছেন বলে জানা যায় না। এই খেচরীমুদ্রার মহানন্ উপকারিতা সম্বন্ধে আরো বিশদভাবে হঠপ্রদীপিকা এবং ঘেরণ্ড সংহিতায় বিস্তারিত ভাবে বলা আছে। এই সকল যোগশাস্ত্রে বলা আছে খেচরীমুদ্রার প্রভাব এত অধিক যে, যদি যুবতী নারীও আলিঙ্গন করে, তথাপি খেচরীমুদ্রাসিদ্ধ সাধকের বিন্দুমাত্র রেতঃপাত হয় না।