এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,১৩ আগস্ট : নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) অধীনে বিহারে ভোটার তালিকা থেকে ৬৫ লাখ নাম বাদ গেছে । তার মধ্যে ৩৫ লক্ষ মানুষ হয় আর পাওয়া যাচ্ছে না অথবা চিরতরে অন্য কোথাও চলে গেছে, ২২ লক্ষ ভোটার মারা গেছেন, ৭ লক্ষ ভোটারের একাধিক স্থানে নাম নথিভুক্ত এবং প্রায় ১.২ লক্ষ ফর্ম এখনও বিচারাধীন । এই সত্য সামনে আসার পর সিঁদূরে মেঘ দেখছে ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও আরজেডি । কারন ওই ভুয়ো ভোটারই ছিল তাদের ‘কোর ভোটব্যাংক’ । নিশ্চিত পরাজয় জেনে তারা এখন সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলছে । ‘ভোট চুরির’ মিথ্যা অভিযোগ তোলা কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী ইন্ডি জোটকে নিয়ে প্রতিদিন এনিয়ে চিৎকার করলেও নির্বাচন কমিশনের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পেশ করতে পারেননি । এটা স্পষ্ট যে তারা বিহারে তাদের ‘কোর ভোটব্যাংক’ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী মুসলিম ভোটারদের যেমন করেই হোক বাঁচাতে চাইছেন । তাদের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াই লড়ছেন কপিল সিব্বাল,অভিষেক মনুসিংভিরা ।
বিহারের পর পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর প্রাথমিক পর্যায়ে আছে । কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন যে তিনি ভোটার তালিকা থেকে একটা নামও বাদ দিতে দেবেন না । মমতার ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জি তো এক লাখ লোক নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অফিস ঘেরাও করার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে রেখেছেন । কিন্তু এসআইআর নিয়ে কেন এত বেপরোয়া হয়ে উঠল তৃণমূল কংগ্রেস ? বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কথায়,এরাজ্যে অন্তত ১ কোটি ২৫ লাখ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী মুসলিম ভোটার আছে । এখন এসআইআর-এ সেই নাম বাদ গেলে তৃণমূলের পরাজয় নিশ্চিত জেনেই মমতা ব্যানার্জি এত উদ্বিগ্ন ।
তবে শুধু শুভেন্দু অধিকারীই নয়, আইআইএম অধ্যাপকদের গবেষণাপত্রে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশকারী ভোটার নিয়ে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য । ৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত ‘পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী তালিকায় অনুপ্রবেশ : বৈধ ভোটার গণনার একটি জনসংখ্যা পুনর্গঠন ২০২৪’ (Electoral Roll Inflation in West Bengal: A Demographic Reconstruction of Legitimate Voter Counts (2024)’) শীর্ষক একটি গবেষণাপত্রে দেখা গেছে যে পশ্চিমবঙ্গের ২০২৪ সালের ভোটার তালিকায় প্রায় ১ কোটির বেশি জাল নাম ছিল । এটি মোট ভোটারে মধ্যে ১৩.৬৯% অনুপ্রবেশকারী ভোটাকে চিহ্নিত করে ।
পশ্চিমবঙ্গ হল সেই রাজ্য যাকে করিডর হিসাবে ব্যবহার করে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা । অনুপ্রবেশের পর স্থানীয় সহানুভূতিশীল মানুষের সাহায্য নিয়ে তারা জাল কাগজপত্র বানিয়ে ভারতীয় নাগরিক বনে যায় । দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অবৈধ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী এরাজ্যে বসবাস করে করে বলে মনে করা হয় । গত তিন বছরে, ২,৬৮৮ জন বাংলাদেশী নাগরিককে ধরা হয়েছে এবং নির্বাসিত করা হয়েছে। যদিও এই সংখ্যাটি সমুদ্রের মধ্যে এক ফোঁটা জলবিন্দুর মত ।
গত ৮ আগস্ট, তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) সরকার রাজ্যের প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা (সিইও) এর কাছ থেকে ‘স্পষ্টীকরণ’ চেয়েছিল যখন তিনি নির্বাচন কমিশনকে চিঠি লিখেছিলেন যে রাজ্য SIR-এর জন্য ‘প্রস্তুত’। গত সপ্তাহে, নির্বাচন কমিশন ২৯৩টি বিধানসভা আসনের (একটি আসন বাদে) ২০০২ সালের SIR ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, বাংলায় শেষ SIR ২০০২ সালে করা হয়েছিল এবং তার ভিত্তিতেই ২০০৪ সালের ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। এখন যখন ২২ বছর পর আবার SIR হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তখন তা বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে শাসকদল ।
নির্বাচন কমিশনের কাজ হল মাঝেমধ্যে ভোটার তালিকা আপডেট করা, ভুল সংশোধন করা, মৃতদের নাম মুছে ফেলা এবং ভুয়া ভোটার শনাক্ত করা, কিন্তু রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার, যাকে অনেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে মুসলিম তোষণের সাথে যুক্ত করে, এই SIR প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে এবং নির্বাচন কমিশনকে এটি ‘স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে’ এবং চাপও দিচ্ছে। হিন্দি মিডিয়া আউটলেট ওপি ইন্ডিয়া বলেছে,পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িকভাবে সংবেদনশীল রাজ্যে ভোটার তালিকায় অনুপ্রবেশ নতুন কিছু নয় এবং সেই কারণেই SIR-এর প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় অনুপ্রবেশ নিয়ে আইআইএম অধ্যাপকদের গবেষণা
গত ৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত ‘পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী তালিকায় অনুপ্রবেশ : বৈধ ভোটার গণনার একটি জনসংখ্যা পুনর্গঠন (২০২৪)’ (Electoral Roll Inflation in West Bengal: A Demographic Reconstruction of Legitimate Voter Counts (2024)’) শীর্ষক একটি গবেষণাপত্রে দেখা গেছে যে পশ্চিমবঙ্গের ২০২৪ সালের ভোটার তালিকায় প্রায় ১ কোটি জাল নাম থাকতে পারে। এটি ১৩.৬৯% ভোটার অনুপ্রবেশকারী । এই গবেষণাটি করেছেন আইআইএম বিশাখাপত্তনমের ডঃ মিলন কুমার এবং ডঃ বিধু শেখর। তারা ভোটার তালিকা, আদমশুমারি এবং নাগরিক নিবন্ধন ব্যবস্থার মতো সরকারি তথ্য ব্যবহার করেছেন এবং অনুমান কম রাখার জন্য প্রতিটি পর্যায়ে একটি রক্ষণশীল পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে,”আমরা সকল যোগ্য তরুণদের পূর্ণ নিবন্ধন ধরে নিই, উচ্চ বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রয়োগ করি এবং সাম্প্রতিক বৃদ্ধির পরিবর্তে দশকের প্রবণতার উপর ভিত্তি করে অভিবাসনের মডেল তৈরি করি। এর ফলে আমরা বৈধ ভোটার জনসংখ্যার একটি নিম্ন-সীমাবদ্ধ অনুমান তৈরি করতে পারি। এরপর আমরা এই পরিসংখ্যানটি ২০২৪ সালের জন্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত সরকারী ভোটার তালিকার সাথে তুলনা করি ।”
এই গবেষণাটি তিনটি ধাপে ২০২৪ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বৈধ ভোটার জনসংখ্যার অভিজ্ঞতামূলক অনুমান উপস্থাপন করে: (i) ২০০৪ সালের ভোটার তালিকা থেকে বেঁচে যাওয়াদের অনুমান, (ii) ১৯৮৬ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া নতুন ভোটার গোষ্ঠীর সংযোজন, এবং (iii) নেট স্থায়ী অভিবাসনের জন্য সমন্বয়। এরপর গবেষকরা ভোটার তালিকায় আনুমানিক উদ্বৃত্ত গণনা করার জন্য ফলাফল সংশ্লেষণ করেন।
২০০৪ সালের ভোটার তালিকায় ৪.৭৪ কোটি নিবন্ধিত ভোটার ছিল। গবেষণায় এই জনসংখ্যাকে ছয়টি বয়সের দলে ভাগ করা হয়েছিল এবং ২০০১ সালের আদমশুমারির তথ্য ব্যবহার করে বয়স-নির্দিষ্ট ২০ বছরের বেঁচে থাকার হার ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০০৪ সালের ভোটার তালিকা অনুসারে, এই অনুমানগুলি আনুমানিক ৩.৭৪ কোটি বেঁচে থাকা ভোটারকে নির্দেশ করে। অধিকন্তু, গবেষকরা অনুমান করেছেন যে ২০০৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ১ লক্ষ নতুন যোগ্য ব্যক্তি নথিভুক্ত হবেন।
পরবর্তীতে, গবেষণায় ২০০১ এবং ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য ব্যবহার করে স্থায়ী বহির্মুখী এবং অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের অনুমান করা হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মোট অভিবাসীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ২০০১ এবং ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য ব্যবহার করে এবং সিএজিআরের মাধ্যমে অনুমান করে, গবেষকরা অনুমান করেছেন যে এই সময়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মোট ১৭.৮৬ লক্ষ ব্যক্তি স্থায়ীভাবে অভিবাসিত হয়েছেন। বিশ্লেষণ অনুসারে, বৈধ ভোটারের আনুমানিক সংখ্যা (২০২৪) ৬,৫৭,০৬,৮৪৯ জন, যেখানে সরকারী ভোটার তালিকা (২০২৪) অনুসারে ভোটারের সংখ্যা ৭,৬১,২৪,৭৮০ জন। এটি আনুমানিক ১,০৪,১৭,৯৩১ জন ভোটারের উদ্বৃত্ত দেখায়, যা শতাংশের দিক থেকে ১৩.৬৯%।
গবেষকরা বলছেন যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে উচ্চ বেঁচে থাকার হার, উচ্চ নিবন্ধন এবং ধীর অভিবাসনের হার ধরে নিয়েছিলেন, যাতে সর্বনিম্ন জালিয়াতি দেখা যায়, তবুও এত বড় পার্থক্য পাওয়া গেছে। এর অর্থ হল প্রকৃত ভোটার অনুপ্রবেশের চেয়েও বেশি হতে পারে।
এই গবেষণা অনুসারে, এত জাল নাম থাকা নির্বাচনের সুষ্ঠুতার জন্য হুমকিস্বরূপ, কারণ অনেক আসনে জয়ের ব্যবধান এর চেয়ে কম। জালিয়াতি, জাল ভোটদান এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষেত্রে এর সুবিধা নেওয়া যেতে পারে। গবেষণা পরামর্শ দেয় যে ভোটার তালিকা আধার, নাগরিক নিবন্ধন এবং অভিবাসনের তথ্যের সাথে সংযুক্ত করা উচিত। ১০০ বছরের বেশি বয়সী হাজার হাজার ভোটার, একই ব্যক্তির একাধিক নিবন্ধন ইত্যাদির মতো অ্যালগরিদম দ্বারা স্বয়ংক্রিয় পরীক্ষা করা উচিত এবং প্রতি তিন মাসে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক নিরীক্ষা করা উচিত।
ওপি ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,পশ্চিমবঙ্গ এবং এমন রাজ্যগুলিতে যেখানে গত কয়েক বছর ধরে SIR করা হয়নি, ঘরে ঘরে ভোটার যাচাই করা উচিত। ২০২৪ সালে, পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় ১৩.৬৯% অর্থাৎ ১ কোটিরও বেশি জাল নাম থাকতে পারে। এটি নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এ বিষয়ে অবিলম্বে এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ।।