ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদভগবদগীতায় বলেছেন- ‘যোগঃ কর্মসু কৌশলম্’। শ্রীভগবান, উদাত্তকণ্ঠে অর্জুনের মাধ্যমে সকল মানুষকে জানালেন :
“তপস্বিভ্যোহধিকো যোগী জ্ঞানিভ্যোহপি মতোহধিকঃ।
কর্স্মিভ্যশ্চাধিকো যোগী তস্মাদযোগী ভবার্জ্জুন ।” (গীতা ৬/৪৬)
অর্থ : যোগী তপস্বিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, কর্মীগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; অতএব হে অর্জুন, তুমি যোগী হও।
“শ্যামাচরণ ক্রিয়াযোগ ও অদ্বৈতবাদ” পুস্তকে অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায় বলছেন, শ্রী ভগবানের এই উক্তি কোনো স্থান কাল পাত্র ভেদে বলা হয়নি, বরং সর্বকালের মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । শ্রীভগবান যদি বলতেন যে কলিযুগের মানুষ এই যোগ করব করতে পারবে না, তাহলে তিনি কালদোষে দুষ্ট হতেন । বরং শ্রীভগবান বলেছেন যোগকর্ম সুকৌশল যুক্ত । যেহেতু শ্রীভগবানকে কালদোষে দুষ্ট করা যায় না এবং তাঁর উপদেশ অনুসারে যোগকর্মই হোলো একমাত্র সুকৌশলযুক্ত অতএব এই কর্ম সর্বকালে, সর্বধর্মের, সর্ববর্ণের মানুষের পক্ষে একমাত্র সাধন পথ। যোগিরাজও এই কথাই পৃথিবীর মানুষকে পুনরায় শুনিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন,সমাজে ধর্মের নামে যে উন্মত্ত প্রায় ধর্মান্ধতা চলছে তার থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হোলো এই যোগ, যা যোগিরাজ তাঁর ক্রিয়াযোগ সাধনার মাধ্যমে মানুষের পরম কল্যাণের জন্য দিয়ে গেছেন। এই সনাতন যোগসাধন সর্বকালে সর্বমানুষের মধ্যে চিরকাল আছে ও থাকবে। এ পথ আত্মজ্ঞানের পথ, ব্রহ্মজ্ঞানের পথ; এ পথ চির শাশ্বত অমর পথ, সত্যিকার জ্ঞানের পথ, নিজেকে জানার পথ। কিন্তু কোনো বিশেষ দেব-দেবীকে জানার পথ নয়, যদিও এ পথে চললে সকল দেব-দেবীকে আপনাহতেই জানা যাবে, কিন্তু সেটা যোগীর গন্তব্যস্থল নয়। যোগীর গন্তব্যস্থল হোলো যেখান থেকে সে এসেছে সেখানে, সেই নিশ্চল ব্রহ্মে ফিরে যাওয়া এবং মিশে যাওয়া। তাই যোগিরাজ বলেছেন-‘ক্রিয়া সত্য আর সব মিথ্যা’।
অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর লেখনীতে বলছেন,
যোগিরাজ প্রদর্শিত এই ক্রিয়াযোগ হোলো এক সুপ্রাচীন বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞান মতে দেহের অনিত্যতা প্রভৃতি পর্যালোচনা করে এবং একমাত্র পরমাত্মাকেই নিত্য জেনে সর্বদা মুক্তির জন্য যত্ন করা উচিত। কুবুদ্ধি মানবগণের অসংযত আত্মা বন্ধের কারণ, কিন্তু বুদ্ধিমান কর্তৃক সংযত হলে অর্থাৎ স্থির হলে সেই আত্মাই ক্লেশ-রাশি নাশ করে থাকেন। যোগিরাজ এবং সর্বশাস্ত্র একথাই শিক্ষা দেন যে একমাত্র আত্মাই সমস্ত আশ্রমবাসীগণের জিজ্ঞাস্য; সেই আত্মাই কেবল শ্রোতব্য, মন্তব্য, জ্ঞাতব্য এবং যত্নসহকারে দ্রষ্টব্য। আত্মজ্ঞান হতেই মুক্তি হয়, যোগ ব্যতিরেকে আত্মজ্ঞান হয় না, সেই যোগও সতত অভ্যাসবশে সিদ্ধ হয়ে থাকে। অরণ্য আশ্রয় করলেই বা সংসার ত্যাগ করলেই যোগসিদ্ধ হয় না, আত্মজ্ঞান হয় না অথবা নানাবিধ শাস্ত্রচিন্তা, দান, ব্রত, তপস্যা, যজ্ঞ, নানাপ্রকার আসন, নাসাগ্র-দর্শন, শৌচ, যৌন, বাহু-পূজা বা মন্ত্রের আরাধনায়ও যোগসিদ্ধ হয় না। এরজন্য চাই অধ্যাবসায়, সর্বদা অভ্যাস, একান্ত নিশ্চয়তা ও বারবার ক্রিয়া অবলম্বনে যোগসিদ্ধ হয়ে থাকে। একারণেই যোগিরাজ বলেছেন-‘ক্রিয়া করাই বেদপাঠ’। অন্যকিছুতে হয় না। আত্মার সহিত সতত মিলিত হয়ে আত্মাতেই পরিতৃপ্তি লাভ করে, যিনি আত্মাতেই সর্বদা অবস্থিত তাঁরই যোগসিদ্ধি। এই সংসারে যিনি আত্মা ভিন্ন অন্য কিছু দেখেন না, সেই আত্মারাম যোগিশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মময় হন। পণ্ডিতগণ আত্মার সহিত মনের সংযোগকেই বা জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার মিলনকেই যোগ বলেন; কেউ কেউ আবার প্রাণ ও অপান বায়ুর মিলনকেও যোগ বলেন। তেমনি অপণ্ডিতগণ বিষয় ও ইন্দ্রিয়ের সংযোগকে যোগ বলে। এই সমস্ত বিষয়াসক্তের কাছে জ্ঞান ও মোক্ষ বহু দূরে। যতক্ষণ পর্যন্ত চিত্তবৃত্তি নিবৃত্ত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত যোগ কোথায়? যিনি মানসিক বৃত্তি সকল বোধ করে মনকে একমাত্র পরমাত্মার সহিত মিলিত করেন, তিনি মুক্তিলাভ করে থাকেন। এই অবস্থাপন্ন যোগী যুক্ততম অবস্থা লাভ করেন তাই তাঁকে যোগী বলা হয়। বহির্মুখী ইন্দ্রিয়সমূহকে প্রাণকর্মের দ্বারা অন্তর্মুখী করে মনেতে মন লীন করতে হবে, তারপর সর্বপ্রকার ভাব হতে নির্মূক্ত সেই ক্ষেত্রজ্ঞ জীবকে পরব্রহ্মে অর্থাৎ স্থির ‘ব্রহ্মে লীন করা, এরই নাম ধ্যান বা যোগ, এছাড়া আর সব শাস্ত্র, সাধন ইত্যাদি বাহুল্য মাত্র। সমস্ত লোক যা ‘নেই’ বলে মনে করে, আবার পরমাত্মার সঙ্গে জীবের ঐক্য আছে একথা বলতে গেলেও লোক রিরুদ্ধ বাক্য বলা হয়, সুতরাং তেমন বাক্য লোকের হৃদয়ে স্থান পায় না। তাই সেই ব্রহ্ম যা চিরস্থির তা কেবল আত্ম- বোধগম্য, যোগিগণই জানেন। কুমারী যেমন স্ত্রীসুখ অজ্ঞাত, জন্মাবধি অন্ধের যেমন বর্তিকাজ্ঞানের অভাব তেমনি অযোগিগণ পরমাত্মাকে জানতে পারে না। সর্বদা যোগাভ্যাসনিরত ব্যক্তির সেই পরমাত্মা বিজ্ঞেয় হন; কারণ অতিশয় সুক্ষত্মনিবন্ধন সেই পরব্রহ্ম সনাতনকে সহসা অন্ত কোনপ্রকারে নির্দেশ করা যায় না। জল যেমন ক্ষণকাল স্থির থাকে না, সেইরূপ বাতাহত জলের ন্যায় মানবচিত্ত সর্বদাই চঞ্চল, কারণ প্রাণবায়ু চঞ্চল। সেই চঞ্চলচিত্তকে স্থির করবার একমাত্র উপায় প্রাণবায়ুর নিরোধ। প্রাণবায়ুকে নিরোধ করবার জন্য ষড়ঙ্গযোগ অভ্যাস প্রয়োজন।।