বাংলাদেশি হিন্দুদের উপর নির্যাতনের শুরু সেই দেশ ভাগের সময় থেকে । দেশভাগের সময় বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশ৷ সংখ্যা গুরু মুসলিমদের অত্যাচারে সেই সংখ্যাটা নামতে নামতে আজ ৭ শতাংশ এসে পৌঁছেছে । প্রথম প্রধানমন্ত্রী মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে আজকে মহম্মদ ইউনূসের তদারকি সরকারের আমল পর্যন্ত হিন্দুদের উপর নির্যাতন কমেনি, পরম ধাপে ধাপে বেড়েছে । বর্তমান সময়ে সেই নির্যাতন চরম আকার ধারণ করেছে । কিন্তু কেন সরকার বদলালেও হিন্দুদের ভাগ্য বদলায় না বাংলাদেশে ? বাংলাদেশের একটা সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে । ‘হিন্দু নিউজ’ নামে ওই চ্যানেলের লেখা প্রতিবেদনটি নিচে তুলে ধরা হয় :
“আমার সব শেষ। ঘরবাড়ি, মন্দির সব পুড়িয়ে দিয়েছে। শুধু এক কাপড়ে জীবনটা নিয়ে পালিয়ে এসেছি। ভোটের সময় নেতারা এসে আশ্বাস দেয়, কিন্তু ভোট গেলেই আমরা একা। এই দেশটা কি আমাদের না?” – কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন গত বছর নড়াইলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার এক ভুক্তভোগী। তার এই আর্তনাদ শুধু একার নয়, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু মানুষের প্রতিধ্বনি।
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হয়, ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, কিন্তু একটি বিষয় প্রায় অপরিবর্তিত থেকে যায়—সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও নির্যাতন। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, নির্দিষ্ট সময় পরপর দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে হিন্দু বাড়িঘর, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটে। কেন এই চক্র ভাঙা যায় না? কেন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও হিন্দুদের ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ সরে না?
ঘটনার পুনরাবৃত্তি : একটি পরিচিত চিত্রনাট্য
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ধরণগুলো প্রায় একই রকম: নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা । নির্বাচনের আগে বা পরে হিন্দু সম্প্রদায়কে ভয় দেখিয়ে নির্দিষ্ট দলকে ভোটদানে বিরত রাখা বা নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে তাদের উপর হামলা চালানো হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে দেশব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর চালানো নির্যাতন এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। আবার, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও-পরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
ধর্মীয় উৎসবকে লক্ষ্যবস্তু করা : দুর্গাপূজার মতো বড় উৎসবের সময় প্রতিমা ভাঙচুর বা মণ্ডপে হামলা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। ২০২১ সালে কুমিল্লায় পূজামণ্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব: তুচ্ছ ঘটনা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়। রামু, নাসিরনগর, নড়াইল বা ভোলার ঘটনাগুলো এর বড় উদাহরণ।
কেন ভাগ্য বদলায় না হিন্দুদের ? মূল কারণসমূহ :
বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে একাধিক গভীর এবং জটিল কারণ জড়িত, যা কোনো একক রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং এটি একটি সামগ্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিফলন।
১. রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার:
হিন্দু সম্প্রদায়কে প্রায়শই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ‘সফট টার্গেট’ বা সহজ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এক পক্ষ হামলা চালিয়ে অন্য পক্ষের উপর দায় চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করে। যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে, তখন হামলা হলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে, ‘হিন্দুদের বন্ধু’ বলে পরিচিত দলটিও তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। অন্যদিকে, বিএনপি বা অন্য দলের শাসনামলে হামলা হলে তাকে সরকারের নীতির প্রতিফলন হিসেবে দেখানো হয়। এই রাজনৈতিক খেলায় বলির পাঁঠা হয় সাধারণ হিন্দুরা।
২. ভূমি ও সম্পত্তি দখল:
অনেক ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনে মূল উদ্দেশ্য থাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভূমি, বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করা। হামলা চালিয়ে তাদের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করা হয়, যাতে তারা দেশ ছাড়তে বা জলের দরে সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই দখল প্রক্রিয়ায় স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত থাকে, এবং তাদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রায়শই মুখ্য হয় না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্যান্য দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারাও এই দখলদারিত্বের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে।
৩. বিচারহীনতার সংস্কৃতি:
হামলার পর মামলা হলেও তার বিচার প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী আসামিরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। সাক্ষী বা ভুক্তভোগীরা ভয়ে মুখ খোলে না। বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকায় অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি নতুন হামলা চালাতে অপরাধীদের উৎসাহিত করে। নাসিরনগর বা রামুর ঘটনায় জড়িত মূল হোতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হয়নি।
৪. রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ঐতিহাসিক দুর্বলতা:
অর্পিত সম্পত্তি আইনের (পূর্বের শত্রু সম্পত্তি আইন) মতো বৈষম্যমূলক আইনের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব হিন্দু সম্প্রদায়কে অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে রেখেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি অংশ ঐতিহাসিকভাবেই সংখ্যালঘুদের সমান নাগরিক হিসেবে দেখার মানসিকতা থেকে সরে এসেছে, যা মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনিক ও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার জন্ম দেয়।
৫. সামাজিক মেরুকরণ ও উগ্রবাদের বিস্তার:
সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশে সামাজিক ও ধর্মীয় মেরুকরণ বেড়েছে। একটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠী সব সময় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে সক্রিয় থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারের ফলে এই বিদ্বেষ ও গুজব খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সংগঠিত হামলা চালানো সহজ হয়।
উপসংহার :
সরকার বদল হলেই যে কোনো সম্প্রদায়ের ভাগ্য বদলে যাবে, এই ধারণাটি সরলীকরণ। যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজনৈতিক দলগুলো হিন্দু সম্প্রদায়কে ‘ভোট ব্যাংক’ বা ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করবে, যতক্ষণ না ভূমি দখলের মতো অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যকে কঠোর হাতে দমন করা হবে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিটি হামলার ঘটনার দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সহিংসতা চলতেই থাকবে। বাংলাদেশের সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা থাকলেও, হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য সেই অধিকার এখনও এক অলীক স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেছে। তাদের ভাগ্য পরিবর্তন কোনো নির্দিষ্ট সরকারের উপর নয়, বরং রাষ্ট্রের সামগ্রিক চরিত্র ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল।।

