আধুনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত
তমলুকের এক বনেদি বাড়ির একমাত্র মেয়ে অন্বেষা মজুমদার। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, টানা টানা চোখ আর মিষ্টি হাসিতে অন্বেষার নিজস্ব একটা আকর্ষণ ছিল। তার সঙ্গে তার রুচিসম্মত পরিধান এবং মার্জিত ব্যবহার তাকে অনন্য করে তুলেছিল। তমলুক থানার কাশিপুর গ্রামে তাদের প্রাচীন জমিদার বাড়ি। বাবা ছিলেন নামকরা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। অন্বেষার পড়াশোনায় খুব আগ্রহ ছিল, ছোটবেলা থেকেই সে ছিল মেধাবী ছাত্রী। স্বপ্ন দেখত একদিন কলেজের অধ্যাপিকা হবে,
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস অন্যরকম লেখা ছিল। যখন সে কলেজে গ্রাজুয়েশনের শেষ বর্ষে, তখন বাবার এক বন্ধুর ছেলে, অরিন্দমের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব আসে। অরিন্দম কলকাতার আরজিকর মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক। প্রথম দিকে অন্বেষার এই বিয়েতে ঘোর আপত্তি ছিল। সে চেয়েছিল পড়াশোনা করতে, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে। বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা করতে ।তার মনে তখনও অধ্যাপিকা হওয়ার স্বপ্ন বাসা বেঁধেছিল। কিন্তু পরিবারের চাপে, বিশেষ করে বাবার অসুস্থতার কারণে, অন্বেষা প্রতিবাদ করতে পারেনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়।
বিয়ের পর অন্বেষা নতুন পরিবেশে আসে। প্রথম কিছুদিন অরিন্দমের সাথে তার সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। অরিন্দম শিক্ষিত, মার্জিত এবং কেয়ারিং ছিলেন। অন্বেষা ধীরে ধীরে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়, হয়তো নিজের স্বপ্নকে কিছুটা হলেও চাপা দিয়ে সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সম্পর্কের রঙ বদলাতে শুরু করে।
অরিন্দমের উপর বাড়তে থাকে কাজের চাপ। দিনের পর দিন হাসপাতালে ডিউটি, রাতের পর রাত জেগে রোগীর সেবা করা – এই রুটিনে অরিন্দম ক্লান্ত ও খিটখিটে হয়ে পড়ে। সেই ক্লান্তি আর বিরক্তি গিয়ে পড়ে অন্বেষার উপর। সামান্য ভুলত্রুটি নিয়েও অরিন্দম অন্বেষাকে কটু কথা শোনাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বাড়ে মানসিক অত্যাচার।
এমনকি অন্বেষা প্রতি অযথা সন্দেহের বসে অন্বেষাকে বাড়ি থেকে বের হতে পর্যন্ত দিত না। শেষের দিকে অন্বেষাকে ডিউটি এর আগে অন্বেষাকে কখনো কখনো চেয়ার বা খাটের সঙ্গে বেঁধে সে চলে যেত। বাড়ি ফিরে এসে চলত অকথ্য অত্যাচার। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে কখনো কখনো সিগারেটের ছ্যাকা পর্যন্ত অরিন্দম দিয়েছে। প্রথমদিকে অন্বেষা সবকিছু সহ্য করলেও একটা সময়ে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তা সত্ত্বেও অন্বেষা বিভিন্ন হসপিটাল, মানসিক চিকিৎসক এর সঙ্গে কথা বলে অরিন্দমের মানসিক চিকিৎসার জন্য। সে মনে মনে ভাবত যদি অরিন্দম সুস্থ হয়ে যায় তাহলে হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। অন্বেষা ভেবেছিল হয়তো সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দিনের পর দিন অরিন্দমের অত্যাচার বেড়েই চলল। একসময় তা অসহ্য হয়ে ওঠে। অন্বেষা বুঝতে পারে, এই সম্পর্ক আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
তার সব স্বপ্ন ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছিল, তার আশা ভসরা ধূসর থেকে ধূসর হতে শুরু করে। ওই সময় অরিন্দমের চিকিৎসক ডক্টর সুবির নাগ বলেছিলেন অন্বেষা বলে “মা” তোমার কম বয়স, তুমি একজন ভালো স্টুডেন্ট, তোমার একটা ব্রাইট ফিউচার আছে, এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করছে! তুমি এখান থেকে বেরিয়ে আসো। ক্রমশ অন্বেষা দেওয়ালে পিঠ থেকে যায়।
একদিন সাহস করে অন্বেষা অরিন্দমকে জানায় এভাবে চলতে থাকলে তার সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু অরিন্দম তা উড়িয়ে দেয়, বরং অন্বেষাকে দুর্বল ও সংবেদনহীন বলে অভিযুক্ত করে। সেইদিনই অন্বেষা সিদ্ধান্ত নেয়, আর নয়। সে তার নিজের পথে হাঁটবে।
অন্বেষা বাবার কাছে ফিরে আসে। প্রথমে বাবা-মা কিছুটা হতাশ হলেও, মেয়ের মানসিক শান্তির জন্য তারা তাকে সমর্থন করেন। অন্বেষা আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিয়ের আগে যে স্বপ্ন সে দেখেছিল, সেই স্বপ্নকে সে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলে। তমলুকের তম্রলিপ্ত মহিলা মহাবিদ্যালয় ভর্তি হয়ে অন্বেষা নতুন উদ্যমে পড়াশোনা শুরু করে। পুরনো বন্ধুদের সাথে আবার দেখা হয়, নতুন বন্ধু তৈরি হয়। শিক্ষকরা তার আগ্রহ ও মেধা দেখে মুগ্ধ হন। অন্বেষা বুঝতে পারে, পড়াশোনার জগতে ফিরে এসে সে যেন নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছে।
অরিন্দমের সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা শুরু হয়। আইনি লড়াইয়ের ধকল তাকে কিছুটা ক্লান্ত করলেও, অন্বেষা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। অবশেষে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর তাদের ডিভোর্স হয়। অন্বেষা মুক্তি পায় একটি দমবন্ধ করা সম্পর্ক থেকে।
ডিভোর্সের পর অন্বেষা আরও মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে। মাস্টার্সে সে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় এ প্রথম স্থান অধিকার করে। গোল্ড মডেল পায় ।এরপর আর পিছন ফিরে তাকায়নি। কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতার ফলস্বরূপ, অন্বেষা বর্ধমান শহরের নামকরা একটি কলেজের বাংলার বিভাগের অধ্যাপিকা হিসেবে যোগদান করে।
আজ অন্বেষা মজুমদার কলেজের একজন জনপ্রিয় অধ্যাপিকা । তার ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শোনে। জ্ঞানের আলোয় সে আলোকিত করে তোলে তাদের ভবিষ্যৎ। নিজের জীবনের কঠিন পথ পেরিয়ে এসে অন্বেষা আজ অনেক মেয়ের কাছে অনুপ্রেরণা।
তমলুকের সেই শ্যামবর্ণা মেয়েটি আজ শুধু একজন সফল অধ্যাপিকাই নন, বরং একজন আত্মনির্ভরশীল নারী, যে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য সমাজের রক্তচক্ষুকেও উপেক্ষা করতে পারে। তার জীবন প্রমাণ করে, ইচ্ছাশক্তি আর সাহস থাকলে সব বাধাই অতিক্রম করা যায়।
আর কলেজে এসেই পরিচয় হয় সৌম্যর সঙ্গে।
ক্রমশ……..

