কংগ্রেস, বামপন্থী, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, আম আদমি পার্টির প্রভৃতি রাজনৈতিক দলগুলির মুসলিম তোষণের রাজনীতির নতুন ঘটনা নয় । আর তাদের তোষণের রাজনীতির ফলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্যের বহু এলাকায় অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের জন্য জনবিন্যাসের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে । পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদা, দুই চব্বিশ পরগনা, দিনাজপুর সহ একাধিক জেলায় হিন্দু সম্প্রদায় কার্যত সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে । তবে যে ঘটনাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে তা হল পশ্চিমবঙ্গে কট্টর ইসলামী মানসিকতার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি । সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পূজা মন্ডপে একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটেছে । সম্প্রতি মুর্শিদাবাদে ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার বানানো হয়েছে সেখানকার হিন্দুদের । রাজ্য বিজেপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার বিষয়গুলিকে কাকতালীয় হিসেবে নিতে নারাজ । তিনি এক্স-এ বলেছেন,’আনসারুল্লাহ বাংলা” সন্ত্রাসী সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বিস্তার নতুন কোনো ঘটনা নয়। বিভিন্ন এলাকায় তাদের ভোটার আইডি পাওয়া গেছে, এমনকি কিছু ব্যক্তি একাধিক ভোটার কার্ডও ধারণ করছেন ।’ অর্থাৎ তার স্পষ্ট ইঙ্গিত যে এরাজ্যে ইতিমধ্যেই ঘাঁটি গেড়েছে বাংলাদেশের কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদি গোষ্ঠীগুলি । যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিকে এক সময় নিষিদ্ধ করেছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সুকান্ত মজুমদার একটি বাংলা সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট শেয়ার করেছেন । ‘বৃহৎ বাংলা’ গঠনে নিশানা দুই জেলা, পরে কলকাতা! প্রশিক্ষণ আমলাদেরও” শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে যে তথ্য প্রকাশ্যে আনা হয়েছে তা এক কথায় ‘ভয়ঙ্কর’ । সুকান্ত মজুমদার লিখেছেন,এখন, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মিডিয়া সূত্র থেকে পাওয়া নতুন রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ সমর্থিত সন্ত্রাসী সংগঠন, জামাত গ্রুপ এবং কিছু অন্যান্য অপারেটিভরা মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলার মতো এলাকায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য দ্রুত কাজ করছে। পরে, তারা তাদের প্রভাব সেভেন নর্থইস্টার্ন স্টেটস সহ উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর এবং দক্ষিণ দিনাজপুর, এবং কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চায়। এই পুরো অপারেশন বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সমন্বিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের লক্ষ্য হল সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া, ‘কাফির’ নির্মূল করা, মূর্তি পূজা বন্ধ করা, প্যান্ডেলে বোমা হামলা চালানো, এবং দেশীয় ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছু ধ্বংস করা।’
তিনি আরও লিখেছেন,’সম্প্রতি দুর্গাপুজো, কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কার্তিকপুজো এবং সরস্বতীপুজো উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মন্দিরে হামলা হয়েছে। এছাড়াও, দুর্গাপুজোর মহাঅষ্টমী পূজা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে মন্দিরগুলিতে আক্রমণ করা হয়েছে। তাছাড়া, ওয়াকফ দাবি এবং মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এবং শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সহায়তায়, মালদা এবং মুর্শিদাবাদে বিশেষভাবে হিন্দুদের টার্গেট করে একটি সন্ত্রাসী পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়াও, আশোকনগরের মতো এলাকায়, যখন পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান ওঠে বা পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো হয়, পুলিশকে সেই প্রতিবাদীদের রোধ করতে দেখা গেছে — যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে তৃণমূল কংগ্রেস এই কার্যকলাপে পূর্ণভাবে জড়িত।’
সুকান্ত মজুমদারের শেয়ার করা ওই সংবাদপত্রে প্রকাশিত অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা প্রতিবেদনটি নিচে তুলে ধরা হল,’ডায়েরিটা শেখ হাসিনার আমলের। বাংলাদেশের সরকারি আমলাদের ব্যবহারের জন্য বাংলা ও ইংরেজি সন-তারিখ লেখা এই ডায়েরি দেওয়া হয় জনপ্রশাসন দপ্তর থেকে। চলতি বছরের মার্চের গোড়ায় সূত্র মারফত সেটি হাতে পেয়ে চমকে উঠেছিলেন ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর এক কর্তা। পড়তে পড়তে রাত কেটে গিয়েছিল। আতঙ্ক চেপে বসেছিল। সবিস্তার রিপোর্ট পৌঁছেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উপরতলায়। কী আছে সেই ডায়েরিতে ?
২০২৩-এর মাঝামাঝি তিন দিনের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণে গিয়েছিলেন ডায়েরির মালিক, যিনি জামায়াতে ইসলামির সমর্থক এবং বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পদে নিযুক্ত। সরকারি প্রশিক্ষণ নয়, জামায়াতে ইসলামি ও হেফাজতের ঘনিষ্ঠ মৌলানারা ছিলেন বিশেষ ভাবে বাছাই করা এই আমলাদের প্রশিক্ষক । প্রশাসনে থেকেও দেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জেহাদে তাঁদের কী কী করা উচিত, তা শেখানো হয়েছে অনুগত আমলাদের। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার
পরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে দ্রুত ‘বৃহৎ বাংলা’ খিলাফত কায়েমের লড়াইয়ে নামা হবে বলে জানানো হয় ওই প্রশিক্ষণে। কী হবে ‘বৃহৎ বাংলা’ খিলাফতের ভৌগোলিক সীমানা, কী ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রচলনের কথা ভাবা হচ্ছে, সে সব তাঁদের কাছে খোলসা করা হয়েছে।
‘ইসলামি শাসন কায়েম’ এবং ‘কাফের, মুরতাদ, নাস্তিকদের’ উচ্ছেদ করার জন্য কী পন্থার কথা ভাবা হয়েছে, সে সবও প্রশিক্ষকেরা জানিয়েছেন সমর্থক সিনিয়র আমলাদের। অতি যত্নে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাংলায় সে সব নোট নিয়েছেন ডায়েরির মালিক। কৌশলে হস্তগত করে সেই ডায়েরি ভারতীয় গোয়েন্দা কর্তাদের হাতে তা তুলে দেন তাঁর এক জন ‘বিশেষ সূত্র’।
প্রশিক্ষণে ‘বৃহৎ বাংলা’ খিলাফতের যে ভৌগোলিক সীমানার কথা বলা হয়েছে, তাতে সম্পূর্ণ বাংলাদেশ তো রয়েইছে, সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বের ৭রাজ্য এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা, কোচবিহার,জলপাইগুড়ি এবং দুই দিনাজপুর জেলাকেও ধরা হয়েছে। জানানো হয়েছে, আপাতত তাদের নিশানা মুর্শিদাবাদ, মালদা এবং দুই দিনাজপুর জেলা। মৌলবাদী ও জঙ্গিরা এই অংশকে নিয়ে পৃথক একটি প্রদেশ গঠন করতে চায়, যার রাজধানী হবে মালদা। তার পরে কলকাতা ও দুই ২৪ পরগনা দখল করে হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ‘বৃহৎ বাংলা’ খিলাফতের সীমানা বাড়ানোর কর্মসূচির কথা আমলাদের জানানো হয়েছে।
নামনি অসম, বরাক এবং ত্রিপুরাকে নিয়ে দ্বিতীয় একটি প্রদেশের পরিকল্পনা রয়েছে, যার রাজরানী করতে চাওয়া হয়েছে অসমের ‘মুসলিম অধ্যুষিত’ কোনও শহরকে। গত ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে বাংলাদেশের গত বিজয় দিবসে একটি ফেসবুক পোস্ট করেন মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা এবং ইউনূসের ঘোষণা মতো বাংলাদেশে ‘অত্যুগানের মাস্টারমাইন্ড’ মাহফুজ আলম। জঙ্গি সংস্রবের দায়ে অভিযুক্ত মাহফুজ পোস্টটিতে লিখছেন, ‘এ খণ্ডিত, ঘেরাওকৃত বাংলা দিয়ে আমরা সত্যিকার বিজয়, স্বাধীনতা কিংবা মুক্তি অর্জন করতে পারব না।
হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত জনপদ পুনরুদ্ধার ব্যতীত পোকায় খাওয়া পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ দিয়ে আমরা মুক্তিকে ছুঁতে পারব না।’ লম্বা লেখাটির সঙ্গে মাহফুজ একটি মানচিত্রও পোস্ট করেছিলেন, যার ভৌগোলিক গঠন মৌলবাদী-জঙ্গিদের প্রস্তাবিত ‘বৃহৎ বাংলা’ খিলাফতের হুবহু অনুরূপ। সমালোচনার মুখে কয়েক ঘণ্টা পরে মাহফুজ এই পোস্ট মুহে দিলেও বলেননি যে এর বিষয়বস্তুর সঙ্গে তিনি একমত নন।
ভারতের কব্জা করা অংশে দখল কায়েমের জন্য সন্ত্রাসকেই যে তার প্রধান হাতিয়ার করতে চায় আমলাদের খোলাখুলি তা জানিয়েছেন প্রশিক্ষকেরা। ‘কাফের মালাউনদের’ মূর্তি পুজো বন্ধ করতে ভিড়ে ঠাসা মণ্ডপে ‘একটি-দু’টি বিস্ফোরণ’ বা ‘সশস্ত্র হামলাই যথেষ্ট’ বলে এক আমলার প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন এক মৌলানা। আপাতত সংখ্যাধিক্যের জোরে বিধর্মীদের কোস্টাসা করার কৌশলের কথা জানানো হয়েছে। প্রশিক্ষকদের দাবি, ‘বৃহৎ বাংলা’ য় প্রস্তাবিত ভারতের অংশে তাঁদের যে স্থানীয় ‘সমমনা’ মৌলানার গোপনে নিরন্তর প্রচার চালাচ্ছেন, খিলাফত প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তারাও সামিল হবেন । তাদের কথায়,’কুফরি (ইসলামবিরোধী) আইনে নিষিদ্ধ (যেমন হিযবুত তাহরীর, সঙ্কর, জইশ) ও অনিষিদ্ধ (যেমন জামায়াতে, হেফাজত) সব ধর্মীয় সংগঠন যে খিলাফতের লক্ষ্যে জেহাদকে একমাত্র কর্মসূচি বলে স্বীকার করেছে, তার জন্য জামায়াতে ইসলামি নেতৃত্বের দৌত্যের প্রধান ভূমিকা রয়েছে।
গোয়েন্দাকর্তার কথায়, হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়েই যে এমন উদ্যোগ শুরু হয়েছিল, ২০২৩-এর এই প্রশিক্ষণ তার প্রমাণ। সে দেশের নজরদার সংস্থাগুলিতেও জঙ্গি-অনুগতরা থাকায় সরকারের কানে এই খবর পৌঁছে দেওয়া হয়নি। ৫ অগস্ট হাসিনা সরকারকে উচ্ছেদ করে প্রথম উদ্দেশ্য সাধনের পরে দ্রুত ‘বৃহৎ বাংলা’ খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে জঙ্গিরা। গোয়েন্দাকর্তার কথায়, ইউনুস সরকারের আসন কুশীলব জামায়াতে এবং হিযবুত। তাই চুপিসারে ছাড়া পাচ্ছে শয়ে শয়ে জঙ্গি। তিনি বলেন, ‘আসলে অনুকূল হাওয়া থাকতে থাকতে তাদের লক্ষ্যের দিকে যত দূর সম্ভব এগিয়ে যেতে চাইছে বাংলাদেশের জঙ্গিরা। এ বার তারা আগের চেয়েও সঙ্ঘবদ্ধ ।’।