এইদিন ওয়েবডেস্ক,গাজা,২৫ এপ্রিল : টেলিগ্রাম ভিডিওতে উচ্চকিত কণ্ঠে চলছে এই স্লোগান। কখনও বা সুরে সুরে। বার্তা খুবই স্পষ্ট। আর তা হচ্ছে- ‘হামাসের সবাই হটো।’ গাজার রাস্তায় রাস্তায় আগের চেয়েও অনেক বেশি ফিলিস্তিনি প্রকাশ্যেই ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, যে গোষ্ঠীটি প্রায় ২০ বছর ধরে শাসন করে আসছে গাজা।ছোট্ট, দরিদ্র ভূখন্ড গাজাকে ৭০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বাজে সংকটে ফেলে দেওয়ার জন্য অনেকেই হামাসকে দায়ী করছে। গাজার ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাস্তায় আর একদল বিক্ষোভকারী ‘হামাস জঞ্জাল’- এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার ডাক দিয়েছে।
গাজায় হামাসের সমালোচক এক প্রাক্তন রাজবন্দি ও আইনজীবী মোমেন আল নাতুর বলেন, গাজার পরিস্থিতিতে বিশ্ব ধোঁকা খাচ্ছে। তার কথায়, “বিশ্ব মনে করছে গাজা মানেই হামাস, আর হামাস মানেই গাজা।” তিনি বলেন, “আমরা হামাসকে বেছে নেইনি। অথচ হামাস এখন গাজা শাসন করতে বদ্ধপরিকর এবং তারা তাদের সঙ্গে আমাদের ভাগ্যও বেঁধে নিয়েছে। হামাসকে অবশ্যই সরে যেতে হবে।”
গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে কথা বলাও বিপজ্জনক। হামাস কখনওই ভিন্ন মত সহ্য করেনি। এই পরিস্থিতির মধ্যে মোমেন আল নাতুর ছিলেন নির্ভীক।গত মার্চের শেষ দিকে তিনি দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে একটি কলামে লিখেছিলেন, “হামাসকে সমর্থন দেওয়া মানে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা নয় বরং ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুকেই সমর্থন করা।” বিবিসি জেরুজালেমের এক সাংবাদিক মোমেনকে জিজ্ঞেস করেন, “এভাবে কথা বলা বিপজ্জনক নয় কি?” এ প্রশ্নের জবাবে মোমেন নির্দ্বিধায় বলেন, “আমাদেরকে ঝুঁকি নিয়েই কথা বলতে হয়।” তিনি জানান, এখন তার বয়স ৩০। আর বয়স যখন ১১ ছিল তখন হামাস গাজার শাসনভার নিয়েছিল। কিন্তু তার জীবনে কী হয়েছে? তার জীবনটা কেবল যুদ্ধ আর বাড়তে থাকা সহিংসতার মধ্য দিয়েই নষ্ট হয়েছে। লাভের লাভ কিছুই হয়নি।
হামাস রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহিংস পন্থায় হটিয়ে ২০০৭ সালে গাজার শাসনক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে তিনটি বড় যুদ্ধ এবং দুটো ছোটখাট সংঘাত হয়েছে। মোমেন বলেন, “হামাসের দমনপীড়নের পরও তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আওয়াজ তোলাটা মানবতার দাবি।”
হামাস ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার মধ্যেও তাদের সমালোচকদেরকে শাস্তি দিতে পিছ পা হচ্ছে না। গত মার্চের শেষ দিকে হামাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে এই গোষ্ঠীটি উদয় আল-রুবাই নামের এক ফিলিস্তিনিকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। সশস্ত্র বন্দুকধারী সন্ত্রাসীরা রুবাইকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। পরে তার লাশ পাওয়া যায়। রুবাইয়ের পরিবার এই মৃত্যুর জন্য হামাসকে দায়ী করেছে এবং ন্যায়বিচার চেয়েছে।
রুবাইয়ের শেষকৃত্যে বেশ কিছু ফিলিস্তিনি এ হত্যাকাণ্ডের বদলা নেওয়া এবং হামাসকে গাজা থেকে সরে যাওয়ার দাবি তোলে।এর আগে গত গ্রীষ্মে হামাসের বিরুদ্ধে কথা বলে রুবাইয়ের মতো প্রায় একই ভাগ্য বরণ করেছিলেন আমিন আবেদ নামের আরেক ফিলিস্তিনি। মুখোশ পরা সন্ত্রাসীরা তাকে পিটিয়ে অচেতন করে। শরীরের হাড় ভেঙে দেয় এমনকি কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত করে। আবেদ কোনওভাবে প্রাণে বাঁচলেও তাকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। এখন আবেদ দুবাইয়ে থাকেন। এখনও তিনি হামাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তার বিশ্বাস, হামাসের কর্তৃত্ব খর্ব হয়ে গেছে। তাদের ক্ষমতা শেষ হয়ে আসছে। আবেদ বলেন, “হামাস মানুষজনকে আতঙ্কে রাখতে অধিকারকর্মী,নিরীহ মানুষদের পেটায়, হত্যা করে। তবে এখন আর আগের সেই দিন নেই।”
গতমাসে গাজায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ার পর থেকে ইসরায়েলের অবিরাম হামলায় হামাসের সন্ত্রাসীরা এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। আর গাজাবাসীরা আবার যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে পড়ে গেছে।
সম্প্রতি গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তা থেকে বোঝা যায় সেখানে ইসরায়েলের লাগাতার বোমা হামলায় কোণঠাসা হয়ে পড়া সাধারণ মানুষরা এখন আর হামাসের ভয়ে ভীত নয়। গাজার উত্তরাঞ্চলের বেইত লাহিয়ায় ইদানিং হামাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরাল বিরোধিতা দেখা গেছে। সেখানে কয়েকটি ঘটনায় স্থানীয় মানুষেরা তাদের লোকালয়ের মধ্য থেকে হামাস সন্ত্রাসীদের নাশকতা চালাতে দেয়নি।
এমনই একটি ঘটনার বর্ণনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গত ১৩ এপ্রিলে হামাসের এক সন্ত্রাসী বেইত লাহিয়ার এক বয়স্ক মানুষ জামান আল-মাজনানের বাড়িতে ঢুকে সেখান থেকে রকেট ছুড়তে চেয়েছিল। কিন্তু তা করতে দেননি সেই বৃদ্ধ। আশেপাশের আরও বাসিন্দারা তখন আল-মাজনানের পাশে এসে দাঁড়ান। এরপর সন্ত্রাসরা গুলি চালালে কয়েকজন আহত হন। তবে শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়।সন্ত্রাসীদের বুলেটেও প্রতিবাদী মানুষেরা ভয় পায়নি। বরং সন্ত্রাসীদের সামনে এগিয়ে গিয়ে বলেছিল, তাদের জিনিসপাতি নিয়ে চলে যেতে।প্রতিবাদকারীরা বলেছিল,’আমরা আপনাদেরকে (হামাস সন্ত্রাসী) এখানে চাই না। আমরা আপনাদের অস্ত্র চাই না, যে অস্ত্র আমাদেরকে ধ্বংস, বিপর্যয় আর মৃত্যু এনে দিয়েছে ।’।

