১৯৩১ সালে, ভগত সিংকে জল্লাদ কালা মসিহ ফাঁসি দেন, অনেক পরে তার ছেলে তারা মসিহ ১৯৭৯ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেন। বিশ্বাসঘাতকরা অনেক উন্নতি করলেও জল্লাদের কোনও পদোন্নতি হয়নি ৷ গল্পটি ব্রিটিশ শাসনকালে শহীদ-এ-আজম ভগত সিং-এর ফাঁসির পরের। যে জল্লাদ তাঁকে ফাঁসি দিয়েছিল সে কেবল জল্লাদই থেকে যায় । কিন্তু একটি বড় ফ্রন্ট জয় করার পর (ভগত সিং, রাজগুরু এবং সুখদেবের ফাঁসির পর), ব্রিটিশরা পুরষ্কার এবং সম্মাননার ধারাবাহিকতা শুরু করে।
ভগৎ সিংয়ের বিশ্বাসঘাতক সঙ্গীরা যারা সরকারি সাক্ষী হয়েছিলেন, তাদের মোটা অঙ্কের পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল। হংসরাজ ভোহরা নগদ পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালে, পাঞ্জাব সরকার তাকে আরও পড়াশোনার জন্য লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে পাঠায়। পরবর্তীতে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা ডিগ্রি অর্জনের পর, তিনি লাহোরে সাংবাদিকতা অনুশীলন চালিয়ে যান এবং পরে তিনি ওয়াশিংটনে চলে যান যেখানে তিনি টাইমস অফ ইন্ডিয়া এবং ডুকান ক্রনিকলসের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন এবং ১৯৮৫ সালে সেখানেই মারা যান।
দ্বিতীয় বিশ্বাসঘাতক জয় গোপাল, যাকে একজন বিপ্লবী আদালতে জুতা ছুড়ে মেরেছিলেন, তাকে নগদ ২০,০০০ টাকা দেওয়া হয়েছিল। তৃতীয় এবং চতুর্থ বিশ্বাসঘাতক, ফণীন্দ্র নাথ ঘোষ এবং মনমোহন ব্যানার্জিকে তাদের নিজ জেলা চম্পারণে পঞ্চাশ একর জমি দেওয়া হয়েছিল।
ফাঁসির দুই দিন পর জেল সুপারিনটেনডেন্ট পি. ডি. চোপড়াকে ডিআইজি প্রিজন হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির পর ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট খান সাহেব মোহাম্মদ আকবর খান কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, তার খান সাহেব উপাধি কেড়ে নেওয়া হয় এবং পরে পদাবনতি দেওয়া হয়।
লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খান বাহাদুর আব্দুল আজিজকে দফায় দফায় পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি ব্রিটিশ রাজের প্রথম অফিসার যিনি হেড কনস্টেবল পদে যোগদান করেন এবং ডিআইজি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তার ছেলে মাসুদ আজিজকে সরাসরি ডেপুটি এসপি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। খান বাহাদুরকে লায়ালপুরে পঞ্চাশ একর জমিও দেওয়া হয়েছিল।
মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে মৃতদেহের নিষ্পত্তি পর্যন্ত, সকলকেই দুহাত ভরে পুরষ্কৃত করা হয়েছিল, এতটাই যে কারো মনে কোন অনুশোচনা থাকে না। কারন সমাজে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছিল যাতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত থাকলে কেবল সুবিধাই পাওয়া যায় । আর এই নিয়ম মেনে চললে আপনি শুধু উপকৃত হবেন। ফলস্বরূপ, ভগত সিং, রাজগুরু এবং সুখদেবের ফাঁসির পর, ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন ভেঙে পড়ে।
এর পরে, ১৯৪০ সালে লন্ডনে উধম সিং যখন মাইকেল ও’ডায়ারকে গুলি করেছিলেন তখন কেবল একটি উল্লেখযোগ্য বিপ্লবী ঘটনা ঘটেছিল।বিপ্লবীদের প্রশংসা করার পরিবর্তে যদি আমরা বিশ্বাসঘাতকদের জন্য লজ্জিত হতাম এবং সমাজে মাথা উঁচু করে হাঁটা তাদের জন্য কঠিন করে তুলতাম, তাহলে দেশের জন্য ভালো হত, এমনটাই দেখানো হয়েছিল তখন । ভগত সিং-এর বিশ্বাসঘাতকদের মধ্যে কেবল ফণীন্দ্রনাথ ঘোষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়েছিলেন বৈকুণ্ঠ শুক্লা ।
আমাদের ব্রাহ্মণ ভাইয়েরা, যারা আজ চন্দ্রশেখর আজাদকে তিওয়ারি বলে ডাকতে গর্ব বোধ করেন, তাদের এটাও জানা উচিত যে বীরভদ্র তিওয়ারিই পুলিশকে আলফ্রেড পার্কে তার উপস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। কেউ কেউ এমনকি বলেন যে বীরভদ্রকে দিয়ে এই কাজটি যিনি করিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং জহরলাল নেহেরু। আপনি এটা বিশ্বাস করুন বা না করুন, তারপর থেকে নেহেরুরও অনেক উন্নতি হয়েছে। নেহেরুর ব্রিটিশদের বাড়িঘরে যাওয়ার এবং ব্রিটিশ মহিলাদের সাথে মেলামেশা করার স্বাধীনতা ছিল। নেহেরু এতটাই লাভবান হয়েছিলেন যে ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করার আগে তারা তাকে প্রধানমন্ত্রী করেছিল।
ভগৎ সিং-এর ফাঁসির জন্য মানুষ গান্ধীকে অভিশাপ দেয়। তবে গান্ধীই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন না যিনি সশস্ত্র বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি কথিত অহিংসার পূজারি ছিলেন ।প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন ভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটিশদের হয়ে লড়াই করেছিল, তখন তিনি হয়তো সহিংসতা দেখেননি, অহিংসার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন । বাপু শুধু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের লড়াইয়ের হিংস্রতা দেখতে পেতেন। মানুষ গান্ধীকে যতই দোষারোপ করুক না কেন, যতক্ষণ দেশে এত বিশ্বাসঘাতক থাকবে, ততক্ষণ কোনও বিপ্লবী আন্দোলন সফল হওয়া সম্ভব ছিল না, আর ঘটেছিলও তাই । এর জন্য বাপু একা দায়ী ছিলেন না। দায়ি সেই সমস্ত বিশ্বাসঘাতকরা যারা ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমাতে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল । মুঘল হানাদারদের সময়েও এই বিশ্বাসঘাতকরা সক্রিয় ছিল এবং আজও আছে । কিন্তু ব্রিটিশরা ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে করতে আমরা সেই সমস্ত দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকদের নাম জানারই চেষ্টা করিনি । তাদের নাম পরিকল্পিত ভাবে গোপন করে গেছে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসকাররা ।।

