এইদিন ওয়েবডেস্ক,ভাতার(পূর্ব বর্ধমান),১৮ মার্চ : অবশেষে মারা গেলেন পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার থানার সামনে গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করা ব্যবসায়ী সুশান্ত দত্ত(৬০) । সোমবার বিকেল প্রায় ৪ টে নাগাদ তিনি ভাতার থানার সামনে গায়ে দাহ্য তরল ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন । পুলিশ তাকে উদ্ধার করে তড়িঘড়ি বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে । সেখানে অবস্থার অবনতি হলে গ্রীন করিডর করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় । কিন্তু আজ মঙ্গলবার ভোর প্রায় ৫ টা নাগাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় দাদার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান সুশান্তবাবুর ভাই তাপস দত্ত ৷ এদিকে ওই ব্যবসায়ীর মৃত্যুর পর শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস, প্রশাসন ও ভাতারের বিএলআরও কে কাঠগড়ায় তুলছেন এলাকার বাসিন্দারা ।
ভাতার বাজারে বর্ধমান-কাটোয়া রাজ্য সড়কের পাশে বাড়ি সুশান্ত দত্তর । বাড়ি সংলগ্ন “দত্ত হোটেল” নামে তার একটি খাওয়ার হোটেল রয়েছে তার । আর তার বাড়ি লাগোয়া রয়েছে ভাতার ব্লকের কুলচন্ডা মৌজার (জেএল নম্বর ০৬৫) অন্তর্গত ৯৯৩ দাগে ১.৭৩ একর জলকর বিশিষ্ট “সন্তোষসায়ের” নামে একটা পুকুর । যা ঘিরে দীর্ঘ দিন ধরে বিবাদ চলছে ।
স্থানীয় ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে,পুকুরটি বর্ধমান শহর নিবাসী মৃত অমর তা-এর মৃত মা শিবসুন্দরী তায়ের কাছ থেকে তারা জীবিত থাকার সময় ৩৫ লক্ষ টাকায় কিনেছিলেন সুশান্তবাবু । তার ও তার স্ত্রী সঙ্ঘমিত্রা দত্তর নামে রেকর্ডও হয়ে যায় । কয়েক বছর মাছ চাষও করেন সুশান্তবাবু । কিন্তু পুকুর পাড়ে তার বাড়ি সম্প্রসারণকে ইস্যু করে স্থানীয় দুই ব্যবসায়ী সুশান্তবাবুর পিছু লাগে । আর তাদের ইন্ধন দেওয়ায় অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের এক স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে । বিষয়টি পঞ্চায়েত,প্রশাসন পর্যন্ত গড়ায় । যদিও প্রশাসনের মধ্যস্থতায় পুকুর থেকে কয়েক ইঞ্চি পিলার সরিয়ে নির্মান কাজ সম্পূর্ণ করেন সুশান্তবাবু ।
তবে বিতর্ক এখানেই শেষ হয়নি । পুকুরে মাছ ধরতে গেলে একবার আক্রান্ত হতে হয় সুশান্তবাবুকে । তিনি অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিলেন । সেই হামলায় সন্তোষসায়ের পাড়ের দুই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে । তারা অভিযোগ তোলে যে পুকুরটি ভেস্টেড অর্থাৎ এক নম্বরের খতিয়ানের অন্তর্গত । যদিও দুর্গাপুর নিবাসী সুশান্তবাবুর দাদা আরটিআই করলে ভাতার বিএলআরও অফিস জানায় যে পুকুরটি সুশান্ত দত্ত ও সঙ্ঘমিত্রা দত্তর নামে রেকর্ড কাছে । এর আগেও আরটিআই-এ ভাতার বিএলআরও একই রিপোর্ট দিয়েছিল বলে জানান মৃত ব্যবসায়ীর পরিবার । কিন্তু সোমবার ভাতার বিএলআরও প্রদীপ মণ্ডল ফোনে সাফ জানান যে ওই পুকুরটি এক নম্বর খতিয়ানের অন্তর্গত । যেকারণে বিএলআরও অফিসের ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন মৃত ব্যবসায়ীর পরিবার ।
কেন কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে প্রশাসনকে ?
ওই ব্যবসায়ীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর এখন প্রশাসনের ভূমিকাকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে । এই বিষয়ে ২০২৪ সালের ৩ জুন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহার একটা নির্দেশ খুবই উল্লেখযোগ্য । সুশান্ত দত্ত এবং অনান্য বনাম রাজ্য সরকারের ওই মামলায় (ডভলু.পি.এ ১৫০৮৬ অফ ২০২৪) বিচারপতি ভাতার থানার পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে যথাযথ নিরাপত্তা দিয়ে সুশান্ত দত্তকে মাছ ধরতে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক । মামলায় আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যালেন ফেলিক্স(Allen Felix) এবং রাজ্যের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন দীপাঞ্জন দত্ত ও সৌমেন চ্যাটার্জি । কিন্তু সেই সময় সুশান্ত দত্তকে পুলিশ নিরাপত্তা দেয়নি বলে অভিযোগ ওঠে । তারপর থেকে তিনি পুকুর পাড়ের একাংশের হুমকির জেরে আর পুকুরেই নামতে পারেননি বলে অভিযোগ ।
বিচারপতি অমৃতা সিনহার ওই নির্দেশে বলা হয়েছিল, ‘আবেদনকারীরা ১২ই এপ্রিল, ২০২৪ তারিখে বিবাদী কর্তৃপক্ষের সামনে দাখিল করা ‘প্রতিনিধিত্ব’ বিবেচনা করার জন্য আবেদন করেন। আবেদনকারীরা তাদের নামে রেকর্ডকৃত বিষয়ভিত্তিক পুকুরে মাছ ধরার অনুমতি দেওয়ার জন্য পুলিশের সুরক্ষা প্রদানের জন্য নির্দেশনা চান। মনে হচ্ছে তাৎক্ষণিক রিট আবেদনে সাতজন বেসরকারী বিবাদীকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগ হল যে বেসরকারী বিবাদীরা আবেদনকারীদের মাছ ধরা থেকে বিরত রাখছেন।
আবেদনকারীদের দাবির গুরুত্ব সম্পর্কে না জেনে, কারণ মনে হচ্ছে ভাতর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে একটি প্রতিনিধিত্ব বিবেচনাধীন রয়েছে, তাই তাৎক্ষণিক রিট আবেদনটি ভাতার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ৭ নং বিবাদীকে ১২ এপ্রিল, ২০২৪ তারিখের আবেদনপত্রে আবেদনকারীদের আবেদন আইন অনুসারে বিবেচনা করার এবং আবেদনকারীদের অভিযোগ যথাযথ প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে।’
ওই নির্দেশে আরও বলা হয়েছে,এই আদেশের যোগাযোগের তারিখ থেকে সাত (০৭) দিনের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিন্তু ইতিবাচকভাবে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। আবেদনকারীদের পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীকে আদালতের আদেশ জানানোর সময় ১২ এপ্রিল, ২০২৪ তারিখের প্রতিনিধিত্বের একটি অনুলিপি পূর্বোক্ত বিবাদীর কাছে প্রেরণ করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এই আদালতের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে যথাযথভাবে ডাউনলোড করা এই আদেশের সার্ভার কপির ভিত্তিতে পক্ষগুলিকে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।’

যদিও কলকাতা হাইকোর্টের এই নির্দেশকে স্থানীয় থানা বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ মৃত ব্যবসায়ীর পরিবারের । এদিকে ভাতার পঞ্চায়েত সমিতি থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবরে ওই বিতর্কিত পুকুরটি লিজ দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয় । ভাতারের বিডিও দেবজিৎ দত্ত ও ভাতার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি রূপালি সাহার উপস্থিতিতে তৃণমূলের ওই প্রভাবশালীর ঘনিষ্ঠ এক মাছ ব্যবসায়ীকে পুকুরটি লিজ দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে । যদিও এনিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় বিষয়টি আর এগোয়নি । সেই সময় সুশান্তবাবু ‘এইদিন’কে বলেছিলেন, ‘কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত রায় দিয়েছেন যে ওই পুকুরের মালিক আমি ও আমার স্ত্রী । তারপরেও ভাতার বিএল আরও অফিস পুকুরটি ভেস্টেট (এক নম্বর খতিয়ান) তালিকাভুক্ত করে সম্প্রতি আমাকে নোটিশ পাঠায় । বাধ্য হয়ে আমি ফের আদালতের দ্বারস্থ হই। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গত ২০ জুন রাজ্যের ভূমি সংস্কার দপ্তর থেকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছিল । সেই নির্দেশ উপেক্ষা করেছে ভাতারের শাসকদলের নেতারা । ভাতারের বিডিওকে হাত করে আজ পুকুরটি বেআইনিভাবে লিজ দেওয়া হয়েছে ৷’
তিনি অভিযোগ করেছিলেন ওই প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার ইন্ধনেই ভাতার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি রূপালি সাহা ও বিডিও দেবজিৎ দত্ত আদলতের নির্দেশ উপেক্ষা করে পুকুরটি লিজ দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন । সুশান্তবাবু পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি রূপালি সাহার কাছে ২০ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে উকিলের চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। পাশাপাশি রূপালি বাগ ও বিডিও-এর বিরুদ্ধে আদালত অবমানার অভিযোগে মামলাও করে । গত ২৭ ফেব্রুয়ারী উভয়পক্ষকে নিজের অফিসে নোটিশ করে ডাকেন পূর্ব বর্ধমান জেলা শাসক । ফের ১১ মার্চ দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসেন তিনি । জেলা শাসক প্রথম অভিযোগকারী ভবানী প্রসাদ ভট্টাচার্যকে জরিমানা করেন এবং তার অভিযোগটি খারিজ করে দেন । অর্থাৎ জেলা শাসকও সুশান্তবাবুর বিরুদ্ধে রায় দেন । মৃতের স্ত্রী সঙ্ঘমিত্রা দত্ত জানান, সাথে আইনজীবী না নিয়ে যাওয়ায় তার স্বামীকে ফিরে যেতে বলা হয় । তাই জেলা শাসক বাদীপক্ষের অনুস্থিতিতে কিভাবে একতরফা সিদ্ধান্ত নিলেন তা নিয়্ব প্রশ্ন তুলেছেন তিনি৷ আর যেকারণে তিনি চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে । এখন তার মৃত্যুতে শাসকদল, প্রশাসন এবং বিশেষ করে ভাতার বিএল আরও অফিসকে কাঠগড়ায় তুলছেন মৃত ব্যবসায়ীর পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দারা ।।