এইদিন ওয়েবডেস্ক,সিরিয়া,১৫ মার্চ : সিরিয়ায় আসাদ আল-বশিরের সরকার উৎখাতের পর সেখানে ইসলামি শরিয়া শাসন আরোপ করা হয়েছে। সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি আহমেদ আল-শারা একটি সাংবিধানিক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। সিরিয়ার নতুন বিচারমন্ত্রী শরিয়া (ইসলামী আইন) বাস্তবায়নের ঘোষণা করেছেন। এই ইশতেহারে বলা হয়েছে যে, পরিবর্তনের এক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া দেশটিতে প্রথম পাঁচ বছর ইসলামী শরিয়া শাসন থাকবে। ঘোষণা অনুযায়ী, সিরিয়ায় নারীদের আর বিচারক হতে দেওয়া হবে না; বর্তমান বিচারকদের তাদের পদ থেকে অপসারণ করা হবে। আসলে, অভ্যুত্থানের পর থেকে সিরিয়া নৈরাজ্যের যুগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
নতুন সংবিধানে বলা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী সংবিধানের মতোই ইসলামই দেশের রাষ্ট্রপতির ধর্ম। খসড়া কমিটির মতে, নথিটি আরও স্বীকার করে যে ইসলামী আইনশাস্ত্র, অর্থাৎ শরিয়া, ‘আইনের প্রধান আইনগত উৎস’, ‘প্রাথমিক উৎস’ নয়। এটি ক্ষমতা পৃথকীকরণ, বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নারীর অধিকারের নিশ্চয়তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে কথা বলে।
জাতিসংঘের বিশেষ দূত গেইর পেডারসেন এটিকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বলেছেন যে এটি আইনি শূন্যতা পূরণের একটি পদক্ষেপ। একই সময়ে, উত্তর- পূর্ব সিরিয়ার কুর্দি-নেতৃত্বাধীন প্রশাসন সাংবিধানিক ঘোষণার নিন্দা জানিয়েছে এবং বলেছে যে এটি সিরিয়ার বাস্তবতা এবং এর বৈচিত্র্যের সাথে সাংঘর্ষিক। সিরিয়ায় একটি নতুন এবং স্থায়ী সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ইশতেহার ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে।
প্রসঙ্গত,চলতি বছরের জানুয়ারিতে, বিদ্রোহী সামরিক গোষ্ঠীর কমান্ডাররা শারাকে সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি করেছিলেন। ক্ষমতায় আসার পরপরই, শারা আসাদ সরকারের অধীনে ২০১২ সালে প্রণীত সংবিধান বাতিল করে। এর সাথে সাথে তৎকালীন সংসদ, সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলি ভেঙে দেওয়া হয়। এই ইশতেহারের দশ দিন আগে, শারা এটির খসড়া তৈরির জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। সুন্নি মুসলিম আল-শারার নেতৃত্বাধীন সরকার অন্যান্য ইসলামী গোষ্ঠী দ্বারা সমর্থিত নয়। তাদের মধ্যে একটি সংখ্যালঘু আলাউইত গোষ্ঠী রয়েছে, যারা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বাশার আল- আসাদকে সমর্থন করে। বাশারও এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। আলাউইত সহ বেশ কয়েকটি ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠী আল-শারাকে বৈষম্যের অভিযোগ এনে এর বিরোধিতা করে। এই কারণেই উভয় দলের বিদ্রোহীরা মুখোমুখি।
সিরিয়া ওয়ার মনিটর দাবি করেছে যে এই সংঘর্ষে প্রায় ১,৫০০ জন নিহত হয়েছে। ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস’ গত ৯ মার্চ, চমকপ্রদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। ৭৪৫ জন বেসামরিক নাগরিক ছাড়াও, ১২৫ জন সরকারি সৈন্য এবং আসাদের প্রতি অনুগত ১৪৮ জন যোদ্ধাও নিহত হয়েছেন। এই সহিংসতা বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ, ২০২৫) থেকে শুরু হয়েছিল এবং এখনও থামার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
প্রতিবেদন অনুসারে, বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ, ২০২৫) উপকূলীয় শহর জাবলেহের কাছে একজন পলাতক অপরাধীকে ধরতে নিরাপত্তা বাহিনী পৌঁছালে সংঘর্ষ শুরু হয়, কিন্তু এই সময়ে আসাদের সমর্থকরা তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় বলে অভিযোগ। এর পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নতুন সরকার বলছে যে তারা আসাদের অবশিষ্ট যোদ্ধাদের আক্রমণের জবাব দিচ্ছে। তবে, সংঘর্ষগুলি প্রতিশোধের আক্রমণে পরিণত হয়। গত ৭ মার্চ সুন্নি জঙ্গিরা আলাউইত গ্রাম ও শহরগুলিতে আক্রমণ শুরু করে, মানুষ হত্যা করে। আলাউইত সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ পুরুষকে রাস্তায় অথবা তাদের ঘরের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অনেক জায়গায় ঘরবাড়ি লুটপাট করা হয় এবং তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মহিলাদের উলঙ্গ করে রাস্তায় ঘুরিয়ে দেখানো হত। বানিয়াসের মতো শহরে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে এখনো রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মৃতদেহ।
এই হিংসা হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এর জন্য একটি বড় ধাক্কা, যারা আসাদকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিল। এইচটিএসের নেতৃত্বে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি দামেস্ক দখল করেছিল, কিন্তু এখন তাদের নিজস্ব দেশ পরিচালনার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আলাউইত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এই আক্রমণগুলি সিরিয়ার গভীর ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজনের প্রতিফলন ঘটায়। যদি এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনা হয়, তাহলে এই হিংসা আরও বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে।।