এইদিন স্পোর্টস নিউজ,১০ মার্চ : পাকিস্তান একদিক থেকে খুশিই হতে পারে এখন। ভাগ্যিস, চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পুরোটাই পাকিস্তানে আয়োজিত হয়নি!পুরোটা পাকিস্তানেই আয়োজিত হলে ভারত এভাবে সব ম্যাচ একই ভেন্যুতে খেলার সুবিধা পেত কি না, সেটা তর্কসাপেক্ষ। ভারতকে তাদের দল পাকিস্তানে পাঠানোয় রাজি করাতে অবশ্য পাকিস্তানের দিক থেকে ভারতের সব ম্যাচ লাহোরে আয়োজনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। তবে সেসব এখন অপ্রাসঙ্গিক। ভারত তাদের দল পাকিস্তানে পাঠায়নি, সে কারণে পাকিস্তানের আয়োজনে হওয়া চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারতের ম্যাচগুলো আয়োজনের ভাগ পেয়েছে দুবাই।
তাতে টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বেই বিদায় দেখা পাকিস্তানের এখন খুশি হওয়ার একমাত্র কারণ হতে পারে এই যে, শেষ পর্যন্ত আজ যে দুবাই থেকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপাও নিয়ে গেল ভারত! টুর্নামেন্টের পুরোটা পাকিস্তানে হলে আর ভারত এভাবে ট্রফি জিতে গেলে নিজ দেশে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের উদ্যাপন দেখতে নিশ্চয়ই ভালো লাগত না পাকিস্তানের মানুষের! ভারতের অবশ্য সেসব নিয়ে ভাবার এখন সম্ভবত সময় নেই! চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে আজ নিউজিল্যান্ডকে ৪ উইকেটে হারিয়ে পাওয়া শিরোপা নিয়েই যে তারা এখন ব্যস্ত। ব্যস্ত রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলির সম্ভাব্য শেষটা শিরোপায় আলোকিত হওয়ার আনন্দে।
সে পথে জয়টা অবশ্য একেবারে অনায়াস ছিল না ভারতের জন্য। ভারত সব ম্যাচ দুবাইয়ে খেলেছে, একই মাঠ, চেনা কন্ডিশন, ভ্রমণের ঝক্কি পোহাতে না হওয়া – এসব নিয়ে বিতর্ক তো ছিলই । তবে ভারত যতই সুবিধা পাক, আজ তাদের একেবারে সহজে ছেড়ে দেয়নি নিউজিল্যান্ড, ভারতকে জয় পেতে ৪৯ ওভার পর্যন্ত খেলতে হয়েছে। বরং শেষদিকে যেভাবে চেপে ধরেছিল ভারতকে, তাতে নিউজিল্যান্ডের এখন আফসোস হতে পারে, ভারতকে ২৫২-র চেয়ে অন্তত ২০-২৫টি বেশি রানের লক্ষ্য দিতে পারলেই হয়তো ফলটা অন্যরকমও হতে পারত! ওহ, হ্যাঁ, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে বেমানান আক্ষেপও থাকবে তাদের – ফিল্ডিংটা যদি আরেকটু ভালো হতো!
আগে ব্যাট করে ভারতের স্পিনারদের চাপের মুখে নিউজিল্যান্ড সেভাবে সুবিধা করতে পারেনি। ড্যারিল মিচেলের টেস্ট-গতির ফিফটির পর শেষদিকে তবু তারা যে ৭ উইকেটে ২৫১ রান পর্যন্ত তুলতে পেরেছে, সেটা সাতে নামা মাইকেল ব্রেসওয়েলের ৪০ বলে ৫৩ রানের সৌজন্যে। রান এমনিতে কম, সেটা দুবাইয়ের ধীরগতির পিচ সত্ত্বেও। তারওপর রোহিত শর্মার ঝোড়ো শুরুতে ভারত সহজ জয়ের ইঙ্গিতই দিচ্ছিল। স্থুলতা নিয়ে ট্রলের শিকার রোহিতের অবসর নেওয়া উচিত বলে ভারতের অনেকেই রায় দিয়ে দিয়েছেন। গুঞ্জন আছে, অবসর না নিলেও চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর অধিনায়কত্বটা ছেড়ে দেবেন রোহিত। সব সমালোচনার মুখে আজ রোহিত যেভাবে ব্যাট করেছেন, অন্তত প্রথম দশ ওভারে, সেটা তাঁর হয়ে যা জবাব দেওয়ার দিয়ে দিয়েছে।
ইল জেমিসনকে স্বভাবসুলভ পুলে ছক্কা মেরে শুরু রোহিতের, দ্বিতীয় ওভারে উইল ও’রুয়র্ককে মেরেছেন দুই চার। এরপর থেকে ইনিংস যত গড়িয়েছে, রোহিতের ব্যাটে নিউজিল্যান্ড হয়েছে ছারখার। ষষ্ঠ ওভারে ন্যাথান স্মিথকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে যেভাবে বেইসবল সুইংয়ে ছক্কা মেরেছেন…চোখে লেগে থাকার মতো! স্মিথের নিস্তার তাতেও মেলেনি, বরং পরের ওভারে রোহিত যেভাবে চড়াও হয়েছেন ম্যান হেনরির চোটের কারণে সুযোগ পাওয়া স্মিথের ওপর, তাতে নিউজিল্যান্ডের হেনরিকে নিয়ে আফসোস আরও বাড়ার কথা। অষ্টম ওভারে হেনরিকে এক ছক্কার পর দুটি চারও মেরেছেন রোহিত। পাওয়ার প্লে-র ১০ ওভারেই ৬৪ রান পায় ভারত, তার মধ্যে রোহিতই ৪০ বলে ৫ চার ৩ ছক্কায় করেছেন ৪৯। ফিফটিটা হয়ে গেল ১১তম ওভারের প্রথম বলেই, স্যান্টনারের বলে সিঙ্গেল নিয়ে। তবে এরপর অবশ্য রোহিতের ব্যাট অতটা আর ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেনি। সেটা অবশ্য অনুমিতই ছিল, সে কারণেই হয়তো প্রথম দশ ওভারে রোহিত অতটা আগ্রাসী ছিলেন, যাতে আস্কিং রানরেটটা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
পাওয়ার প্লে-র পর ফিল্ডিং ছড়িয়ে পড়েছে, নিউজিল্যান্ডের স্পিনার স্যান্টনার-ব্রেসওয়েলরা যতটা লাইন-লেংথের নিয়ন্ত্রণে চেপে ধরেছেন, আর ভারতের রানের গতিতে বাধ পড়েছে। রোহিত ফিফটির পর মাত্র দুটি চার মারতে পেরেছেন, এর মধ্যে একটি ইনসাইড এজে।
অন্যদিকে রোহিতের সঙ্গী গিল পাওয়ার প্লে-র দশ ওভারে ২০ বলে তুলেছিলেন ১০ রান, কোনো বাউন্ডারি মারতে পারেননি। পাওয়ার প্লে-র পর শুধু রাচিন রাভিন্দ্রকে একটা ছক্কা মেরেছেন। তবে গিল উইকেটে থাকার কাজটা তো করেছেন, সঙ্গে রোহিতের শুরুর ঝড় মিলিয়ে ১৭ ওভারেই ১০০ পেরিয়ে যায় ভারত। এরপর অবশ্য ভারত জোড়া ধাক্কা খেয়েছে। ১৯তম ওভারে স্যান্টনারের বলে ‘গ্লেন ফিলিপস – ফিল্ডার না বাজপাখি’ ভ্রম তৈরি করা আরেকটি চোখধাঁধানো ক্যাচের শিকার হয়ে আউট হয়ে গেছেন গিল (৫০ বলে ৩১)। এরপর দুবাই স্টেডিয়ামের হর্ষধ্বনির মধ্যে ক্রিজে নামেন বিরাট কোহলি – হয়তো এটাই হয়ে থাকতে পারে তাঁর শেষ ওয়ানডে ইনিংস। কিন্তু কোহলি ইনিংসটাতে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারলেন না। বেশিক্ষণ কী, মিনিট পাঁচেকও থাকতে পারেননি। ২০তম ওভারের প্রথম বলেই ব্রেসওয়েল এলবিডাব্লিউ করে দিলেন কোহলিকে। রিভিউ নিয়েছিলেন কোহলি, বল তাঁর ব্যাটের কানা ছুঁয়েছে কি না সে সংশয় ছিল। রিভিউতে দেখা গেল, বলে-ব্যাটে কোনো সংযোগ হয়নি। ১ রানেই ফিরলেন কোহলি।
রোহিতও এরপর আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। পাওয়ার প্লে-র পর রানের গতিতে বাধ পড়লেও ভারতের আস্কিং রেট তখনো তেমন ধর্তব্যে আসার মতো ছিল না, কিন্তু রোহিত বুঝি হাঁসফাঁস করতে লাগলেন। মুক্তি পেতে রাচিন রাভিন্দ্রকে এগিয়ে এসে উড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আগে থেকেই রোহিতের মনোভাব পড়ে ফেলা রাচিন বলটা করলেন বুদ্ধিদীপ্ত, অফ স্টাম্পের বাইরে শর্ট বল করলেন, রোহিতের ব্যাটের নাগালের বাইরেই থেকে গেল সেটা। স্টাম্পড হয়ে ফিরলেন শেষ পর্যন্ত ৮৩ বলে ৭৬ রান করা রোহিত।
রোহিত যখন আউট হচ্ছেন, ততক্ষণে ভারতের ইনিংসের অর্ধেকের বেশি শেষ। ২৭তম ওভারের প্রথম বলে তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে রোহিত আউট হওয়ার সময়ও ভারত লক্ষ্য থেকে ছিল অর্ধেকেরও বেশি দূরে। নিউজিল্যান্ডের আশা তখন একটু একটু করে বাড়ছে। যদিও ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ অনেক লম্বা, রাভিন্দ্র জাদেজাই নামেন আট নম্বরে! তবু রোহিত-কোহলি-গিলকে ফিরিয়ে নিউজিল্যান্ড ভারতের মিডল অর্ডারের বিপক্ষে স্যান্টনার- ব্রেসওয়েলদের লাগিয়ে দিয়ে লড়াইয়ের আশা তো করারই কথা।তবে শ্রেয়াস আইয়ার ও অক্ষর প্যাটেল চতুর্থ উইকেটে ৬১ রানের জুটিতে সে আশার গুড়ে আবার বালি ঢেলে দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে ৩৭তম ওভারে ৪৪ রানে থাকা আইয়ারের সহজ ক্যাচ যখন লং অনে হাতছাড়া হলো কাইল জেমিসনের, নিউজিল্যান্ড প্রমাদ গুনল। তবে সে ধাক্কাটা বেশি বড় হতে পারেনি, ৩৯তম ওভারে স্যান্টনারের কিছুটা ধীরগতির বলে শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ দিয়ে আউট হয়ে গেলেন আইয়ার। ৪৮ রান করে আইয়ার আউট হওয়ার সময়ও ভারতের সমীকরণ – ৬৮ বলে দরকার ৬৯ রান।
৪১তম ওভারে ভারত ২০০ পার হলো। অক্ষর ও হার্দিক পান্ডিয়া আবার ভারতকে সহজেই লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার আশা দেখাচ্ছেন। কিন্তু ৪২তম ওভারে ২৯ রান করা অক্ষর আউট হয়ে গেলেন। নিউজিল্যান্ডের অবশ্য তখনো আশা বড় হওয়ার সুযোগ ছিল না। ক্রিজে থাকা পান্ডিয়ার সঙ্গে যে যোগ হলেন লোকেশ রাহুল! তবে সমীকরণে তখনো ৫১ বলে ৪৮ রানের সমীকরণ নিউজিল্যান্ডকে মিছে আশা দেখাচ্ছিল ।
উইকেট আরেকটি পেল বটে নিউজিল্যান্ড, তবে সেই ক্ষণ আসতে আসতে ৪৮তম ওভার গড়িয়ে গেল। ততক্ষণে পান্ডিয়া আর লোকেশ রাহুল মিলে ভারতকে জয়ের ১১ রান দূরত্বে নিয়ে গেছেন। পান্ডিয়াকে (১৮) ফিরিয়ে জেমিসন উইকেটের উদ্যাপনও তাই আর সেভাবে করতে পারলেন না। পারবেন কীভাবে, অন্য প্রান্তে যে রাহুল শুরু থেকেই আগ্রাসী! শেষ পর্যন্ত ৩৩ বলে ৩৪ রান করে অপরাজিত থেকে গেলেন রাহুল, আর চার মেরে ভারতের শিরোপা নিশ্চিত করে দেওয়া জাদেজা ৬ বলে ৯ রান করে কাজটা শেষ করে দিলেন।।