এইদিন ওয়েবডেস্ক,বীরভূম,০৩ মার্চ : বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তিনি বলেছেন, সংকট সমাধানে তার বন্ধু ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডঃ ইউনূস গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা নিচ্ছেন, তবে অচলাবস্থা নিরসনে তাকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। বীরভূমের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে এবং বাংলাদেশ কীভাবে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে সে ব্যাপারেও তিনি চিন্তিত। কারণ আমার মধ্যে শক্তিশালী বাঙালী পরিচয় রয়েছে।’ তিনি বলেন,’আমি ঢাকায় দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি এবং সেখানেই আমার শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলাম। ঢাকা ছাড়াও আমি আমার পূর্বপুরুষের ভিটা মানিকগঞ্জে প্রায়ই যেতাম। অপরদিকে মায়ের দিক দিয়ে আমি বিক্রমপুর গিয়েছি। বিশেষ করে সোনারঙে। এই জায়গাগুলো ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদের মতো আমিও চিন্তিত কীভাবে বাংলাদেশ তার ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে।’
অমর্ত্য তার ছোটবেলার বেশিরভাগ সময় ঢাকায় কাটিয়েছেন। তিনি ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন স্কুলে চলে যান এবং সেখানেই পড়াশোনা চালান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশটির উন্নয়ন প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন বলেন,’একসময় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল; পাশাপাশি দেশটিতে জন্মহার কমেছে এবং গড় আয়ু ভারতের চেয়ে বেশি হয়েছে ।’অমর্ত্য সেন বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, বিশেষত নারীর ক্ষমতায়নে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। একজন গবেষক হিসেবে আমি লক্ষ করেছি, এই ক্ষেত্রে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা-বিশেষ করে ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান অনেক বেশি।’
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার কথিত গণঅভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিনই আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে । বাংলাদেশের ইসলামি মৌলবাদীরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি তুলছে । কিন্তু অমর্ত্য সেন চান না এ দলটিকে নিষিদ্ধ করা হোক। তিনি বলেন,’একসঙ্গে কাজ করার যে একটি ধারা বাংলাদেশে আছে। আমি চাই এটির ব্যবহার অব্যাহত থাকুক এবং নির্দিষ্ট কোনো দলকে ঠেলে না দেওয়া হয়। আমি আশা করি বাঙালি স্বাধীনতা এবং বহুত্ববাদ থাকবে। আমি আশা করি ভবিষ্যৎ নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে আগেরগুলো থেকে, যেগুলো তারা দাবি করেছিল নিরপেক্ষ ছিল। এখানে পরিবর্তনের সুযোগ আছে। আমি বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু আমি আশাহীন নই।’
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ছাড়াও সেনাবাহিনী নিয়েও কথা বলেন এই অমর্ত্য । দেশে সেনাশাসন জারির চেষ্টা না চালানোয় সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেন তিনি। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সেনাবাহিনী সাধারণত ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,’ইউনূস (আমার) পুরোনো বন্ধু। আমি জানি তার সক্ষমতা অনেক বেশি। এবং অনেক দিকে তিনি একজন অসাধারণ মানুষ। তিনি বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র নিয়ে শক্তিশালী কিছু বার্তা দিয়েছেন ।’
হঠাৎ কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করলে তার সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয় এমনটি উল্লেখ করে অমর্ত্য দাবি করেন ইউনূসও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন। কিন্তু তিনি সেগুলো উতরে যেতে পারবেন। তিনি বলেন,’যদি আপনি হঠাৎ করে কোনো দেশের প্রধান হন, যেমনটা ইউনূস হয়েছেন, আপনাকে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। ইসলামিক দল রয়েছে, এখন হিন্দু দলও আছে। আমার ডঃ ইউনূসের সক্ষমতার ওপর পরিপূর্ণ আস্থা আছে।’
এছাড়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন নিয়েও কথা বলেছেন অমর্ত্য সেন। তিনি বলেন, ‘সংখ্যালঘু একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কারণ বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের ওপর সুবিচার করা নিয়ে গর্ববোধ করে এবং জামায়াতের মতো দলগুলোকে নজরদারিতে রাখে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতেও মসজিদে হামলা হয়। এসব ঘটনা, হোক সেটি বাংলাদেশ অথবা ভারত, বন্ধ হতে হবে।’ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিয়ে সতর্ক করে অমর্ত্য সেন বলেন, বেছে বেছে কিছু ঘটনা প্রচার করে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া সবচেয়ে সহজ কাজ। ১৯৪০-এর দশকের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়ও এভাবে উত্তেজনা ছড়ানো হয়েছিল, যার ফলে ভয়াবহ রক্তপাত ঘটে। অতীত থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে এগিয়ে যাওয়া উচিত।।