বানা রায়, পূর্ব বর্ধমান, জানুয়ারি: ঝাড়খণ্ড থেকে যাত্রা শুরু করে পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ায় ভাগীরথীর গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে অজয় নদ। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার যাত্রাপথে অনেক জনবসতিকে মাঝেমধ্যেই প্লাবিত করার অভ্যাস রয়েছে অজয়ের। আবার এই মকর সংক্রান্তি উৎসবের সময় বড় শান্ত অজয় । বিস্তীর্ণ চরের বালুভূমির বুক চিরে নিশব্দে বয়ে যাওয়া অজয়ের শীতল জল বয়ে নিয়ে যায় সেই ইতিহাস। বীরভূম জেলার কেন্দুলি থেকে অজয়ের পথ ধরে আউশগ্রাম মেরেকেটে ৪২ কিলোমিটার। মকর সংক্রান্তি উৎসবে কেন্দুলির মেলা ভক্ত কবি জয়দেবকে ঘিরেই। আর কবি জয়দেবকে আবারও গভীরভাবে চেনা যাবে পূর্ব বর্ধমান জেলার আউশগ্রামের বাসিন্দা তরুণ লেখক রাধামাধব মণ্ডলের কলমে।
কবি জয়দেব তুর্কি আক্রমণের কোপে পড়ে বীরভূমের পূণ্যভূমি কেন্দুলি ছেড়ে চলে গিয়ে ছিলেন সুদুর বৃন্দাবনে। তুর্কি হামলা থেকে রক্ষা পেতে রাজা লক্ষ্মণ সেনকেও আত্মগোপন করতে হয়েছিল। আর এই বিদেশী হামলার সময়কাল ছিল বাংলার সমাজজীবন থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অন্ধকারময় এক অধ্যায়। সেসব অজানা অনেক কথা উঠে এসেছে রাধামাধব মণ্ডলের কলমে। রয়েছে কবি জয়দেবের জীবনের নানা অজানা দিক। কবি জয়দেবের জীবন অবলম্বনে একটি গবেষণাধর্মী লেখা রাধামাধব মণ্ডলের লেখা উপন্যাস “ভক্তকবি জয়দেব।”
রাধামাধবের লেখা অজস্র বই রয়েছে। বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি পরম্পরার পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে তাঁর লেখা বইগুলি তথ্য ও সাহিত্যরস সমৃদ্ধ। এবারের নতুন লেখা বাংলা সাহিত্যের প্রথম পর্বের কবি জয়দেবের জীবনী নিয়ে উপন্যাস।প্রায় সাড়ে আটশো বছরের পুরোনো ইতিহাস তুলে ধরছেন। যে ইতিহাস অজয়ের প্রবহমান স্রোতে হারিয়ে গিয়েছিল।সেসময় বীরভূমের এই কেন্দুলি থেকে তুর্কি, মুসলমানদের অত্যাচারে পালিয়ে ছিলেন জয়দেব । সঙ্গে শুধু আরাধ্যা দেবতা রাধামাধব আর ধর্মপত্নী পদ্মাবতী।
রাধামাধব বলছেন,”এই বাংলায় ধর্ম ও সংস্কৃতির উপর এমন অত্যাচার নতুন নয়। অতীতে বিধর্মী মুসলমানদের অত্যাচারের মুখে পড়তে হয়েছিল কবি জয়দেবকেও।”
লেখক এই বাংলার বীরভূমের কেন্দুলিকেই কবি জয়দেব গোস্বামীর জন্মভূমি হিসাবে দেখিয়েছেন। জনপ্রিয় লেখক রাধামাধব মণ্ডলের কলমে আসছে জয়দেব, পদ্মাবতী আর রাজা লক্ষ্মণ সেনের জীবন পর্বের এক প্রেমের কাহিনি। বইটির প্রকাশক কলকাতার বিভা পাবলিকেশন। তাঁর কর্ণধার অনিমেষ পারামানিক বলেন, ”বাংলা সাহিত্যের এক ধূসর সময়ের ইতিহাসকে গল্পের বুননে লেখা। ডাকাতিয়া সাম্রাজ্য, বাংলার অত্যাচার, অজয়ের বাণিজতরিতে ব্যবসা বাণিজ্য সঙ্গে রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজসভার ইতিবৃত্ত। আশ্চর্য এক গল্পের শরীরে বেঁধেছেন লেখক। তাঁকে এবার পাঠক নতুন করে চিনবে।”
লেখক রাধামাধব মণ্ডলের বাবা ছিলেন ইঁটভাঁটার শ্রমিক। নিজেও কাজ করেছেন কৃষি শ্রমিকের। বরাবরই মাটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা নিবিড়। এক সময় নিজের লেখা নাটকের বই বিক্রি করেছেন গ্রামে গ্রামে ঘুরে। সে টাকায় পড়াশোনা চালিয়েছেন। বাংলায় এম এ। বাংলার অখ্যাত গ্রামে গ্রামে, গ্রামীণ মেলায়, সাহিত্যবাসরে দিনযাপন করতে পছন্দ করেন। অভাবের সংসারে মা, বাবাকে লুকিয়ে সাহিত্যের চর্চা চালিয়েছেন রাধামাধব।
একসময় মামা বাড়ির মাস্টার বোমকেশ মণ্ডলের সঙ্গে গিয়ে ছিলেন কেন্দুলির পাশের গ্রাম জনুবাজারের এক সাহিত্যপ্রেমী শিক্ষক রণজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। রাধামাধব জানিয়েছেন তিনিই প্রথম পথ দেখিয়েছিলেন। তখন থেকেই লেখা শুরু । অজয়তীরের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে যেন দেখতে পান বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। শুনতে পান কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া অস্পষ্ট সেসব ধ্বনি। রাধামাধব মনে করেন,অন্তজ্য শ্রেণির মানুষের ভেতরই থাকে বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতির আদিরূপ। তাঁরাই সেই সংস্কৃতির প্রকৃত বাহক। তাঁদের টানেই গ্রামে গ্রামে ঘোরেন তিনি।
‘বাংলার ডাকাতনামা’, ‘বাংলার টহলগান’, ‘ক্ষেত্রসমীক্ষার আলোকে ১০০ চোরের জবানবন্দি,’ ‘বাংলার হারিয়ে যাওয়া লোকগান,’ ‘কৃষি ও কৃষকের গান,’ ‘বাংলার প্রাচীন মহিলামহলের স্মৃতির আড্ডা’ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রয়েছে তার অনেকগুলি বই। এবার তাঁর কলমে চেনা যাবে কবি জয়দেবকে।।