প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৮ ডিসেম্বর : স্বজন সেজে গিয়েছিল শত্রু।প্রৌঢ় মাসি ও মেসোর সম্পত্তি ধন- দৌলতে নজর পড়েছিল স্বজন কন্যার ।সেইসব ধন-দৌলত হাতাতে দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সবার অলক্ষে স্বজন কন্যা প্রৌঢ় মাসি ও মেসোকেই নৃশংস ভাবে হত্যা করে বসে। তবে অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। শ্রীঘর এখন হয়েছে ওই আত্মীয়া কন্যা ও তাঁয় দুই ছেলের ঠিকানা।
প্রৌঢ় দম্পতির বাড়ির সদর দরজার গেটের বাইরের দিকে লাগানো ছিল তালা। তা দেখে কারুর বোঝারই উপায় ছিলনা ওই বাড়ির ভিতরে ঘটে গিয়েছে ভয়ংকর জোড়া খুনের ঘটনা। সেটাই সামনে চলো আসে মঙ্গলবার বিকালে বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে দুর্গন্ধ ছড়ানোর পর । আত্মীয়দের কথা মেনে পুলিশ পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের রবীন্দ্রপল্লী এলাকার ওই বাড়ির সদর দরজায় লাগানো থাকা তালা ভেঙে ঘরের ভিতরে ঢুকতেই চোখ কপালে ওঠে পুলিশের।লণ্ডভণ্ড হয়ে থাকা আলাদা আলাদা ঘরের ভিতর থেকে উদ্ধার হয় নিঃসন্তান প্রৌঢ় দম্পতির রক্তাত মৃতদেহ।এই ঘটনা জানাজানি হতেই রবীন্দ্রপল্লী বাসিন্দা মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে ।ঘর থেকে পুলিশ ৭৫ বছর বয়সী অভিজিৎ যশ এবং ৬৫ বছর বয়সী ছবি যশের মৃতদেহ উদ্ধার করে। তারপর আর কাল বিলম্ব না করে ’সিট’ গঠন করে পুলিশ এই জোড়া খুনের ঘটনার তদন্তে নেমে পড়ে। ।
জেলার পুলিশ সুপার সায়ক দাস নিজে সন্ধ্যায় পৌছে যান ঘটনাস্থলে । একই সময়ে ’স্নিফার ডগ’ নিয়ে ওই বাড়িতে পৌছে যায় পুলিশের তদন্তকারী দল। বাড়ির ভিতরের সবিস্তার খতিয়ে দেখার পর সন্ধ্যায় পুলিশ সুপার সংবাদ মাধ্যমকে জানান,বাইরে থেকে ওই বাড়ির দরজায় তালা লাগানো ছিল। পুলিশ তালা ভেঘে ওই বাড়ির ভিতরে ঢোকে ।বাড়ির ভিতর আলাদা আলাদা ঘর থেকে নিঃসন্তান প্রৌঢ় দম্পতির মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে ।দু’জনকারই মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। ঘরের মধ্যে থাকা দুটি আলমারি খোলা অবস্থায় দেখা গিয়েছে।সেখানে জিনিসপত্র সব ছাড়ানো অবস্থায় ছিল। অন্য ঘরের জিনিসপত্রও তছনছ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। দম্পতিকে যে খুন করা হয়েছে তা জেলা পুলিশ সুপার জানিয়ে দেন । তবে খুনের “মোটিভ’ তখনও হাতড়ে যাচ্ছিল পুলিশ।ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহ দুটি পুলিশ বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছে।
মৃত প্রৌঢ়ের আত্মীয়দের কথা অনুযায়ী, অভিজিৎ যশ পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হওয়ায় এলাকার সব মানুষ এক ডাকে তাকে চিনত।অভিজিৎবাবুর শ্বশুরবাড়ি ভাতার রবীন্দ্রপল্লী সংলগ্ন পালাড় গ্রামে।দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। আগে ভাতার বাজারের কদমতলায় বাড়ি ছিল অভিজিৎ যশের। বাড়ির নিচের তলায় ছিল তার দোকান । বছর দুয়েক আগে কদমতলার বাড়ি বিক্রি করে রবীন্দ্রপল্লীতে নতুন বাড়ি তৈরি করে সেখানেই স্ত্রী ছবিদেবীকে সঙ্গে নিয়ে অভিজিৎ বাবু বসবাস করছিলেন। বয়সের কারণে ব্যবসাও বন্ধ করে দেন তিনি। নিরীহ স্বভাবের ওই দম্পতির সঙ্গে আশপাশের বাসিন্দাদের যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল। সারাটা দিন বাড়ির ভিতরেই তারা কাটাতেন । তবে মিশুকে অভিজিৎবাবু দু’বেলা বাজারহাট করতে বেরিয়ে পরিচিতদের সঙ্গে গল্পগুজব করতেন। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেও অভিজিৎ যশের সুসম্পর্ক ছিল।
আভিজিৎ যশের শালিকা শ্যামলী কোঙার এবং তার মেয়ে তনুশ্রী কোঙার বলেন,’গত শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে আমরা অভিজিৎবাবু ও তার স্ত্রী ছবিদেবীর আর কোন সাড়া পাচ্ছিলাম না । বাড়ির সদর দরজাতেও তালা ঝোলানো ছিল। পাড়া প্রতিবেশীরা মনে করছিলেন অভিজিৎ যশ তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও হয়তো বেড়াতে গিয়েছে ।’ শ্যামলী কোঙার জানান,’অভিজিৎ যশ সম্পর্কে তাঁর দাদু হয় । দাদুর বাড়ির মোবাইল ফোনে ফোন করলে দু’দিন ধরে সুইচ অফ বলছিল।সন্দেহ হওয়ায় মঙ্গলবার ছবি যশের ছোট বোনের নাতি দাদুর বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিতে যায় । সে দেখে বাড়ির সদর দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগানো রয়েছে।বিষয়টি ভালো মনে না হওয়ার তারা ভাতার থানার পুলিশকে ঘটনার কথা জানান।
পুলিশ এসে তালা ভেঙে বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই দেখে বাড়ির শোবার ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে অভিজিৎ যশের মৃতদেহ। আর রান্নাঘরে পড়ে আছে ছবি যশের মৃতদেহ। ঘরের আলমারি ছিল খোলা। সব জিনিসপত্র আলমারির কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। মৃত দু’জনের শরীরেই পুলিশ আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে ।’ তনুশ্রী কোঙার ও শ্যামলী কোঙার দু’জনেই দাবি করেন,’এটা ডাকাতির ঘটনা নয়।তারা সন্দেহ করছেন,’সম্পত্তি ও টাকা পয়সার লোভে ঘনিষ্ঠ কেউ বা কারা ছবি যশ ও তাঁর স্বামী অভিজিৎ যশকে খুন করেছে।
শ্যানলী কোঙার ও তনুশ্রী কোঙারের এই দাবিই শেষ পর্যন্ত সত্যি প্রমাণিত হয়।ঘটনা সামনে আসার তিন ঘন্টার মধ্যে খুনে কিনারা হয়ে যেতেই রাতে ভাতার থানায় সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন পুলিশ সুপার সায়ক দাস। তিনি বলেন,অভিজিৎ যশ ও ছবি যশকে খুনের ঘটনায় অভিজিৎ যশের ’সেজ শালিকার’ মেয়ে মহুয়া সামন্ত ওরফে কেয়া এবং তার দুই ছেলে অরিত্র সামন্ত ও অনিকেত সামন্ত কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেরায় ধৃতরা প্রৌঢ় দম্পতিকে খুনের ঘটনার কথা স্বীকারও করে নিয়েছে।বুধবার ধৃতদের বর্ধমান আদালতে পেশ করে পুলিশ হেপাজতে নেওয়া হবে বলে পুলিশ সুপার জানিয়েছেন।
কি ভাবে এত দ্রত এই জোড়া খুনের ঘটনার কিনারা করা সম্ভব হল?এ নিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘অভিজিৎ যশ ও ছবি যশে’র সঙ্গে কিছুতেই যোগাযোগ করতে না পেরে সুপর্ণা চৌধুরী নামে একজন মঙ্গলবার বিকালে ভাতার থানার জানান ।সুপর্ণা পুলিশ কে জানায়,’অভিজিৎ যশ ও ছবি যশ সম্পর্কে তাঁর মেসো ও মাসি হয়। বৃদ্ধ মেসো ও মাসির মৃতদেহ উদ্ধারের পর অভিজিৎ যশের সেজ শালিকার মেয়ে মহুয়া সামান্তর উপর সুপর্ণার সন্দেহ জাগে।সেই সন্দেহের কথা সুপর্ণা পুলিশকে জানায়।এরপর পুলিশ মৃত দম্পতির অন্য আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে, বিভিন্ন সময়ে মহুয়া প্রৌঢ় দম্পতির কাছে গিয়ে টাকা পয়সা দাবি করতো।এরপরেই পুলিশ মহুয়া সামন্তকে গ্রেপ্তার করে জেরা শুরে করে । জেরায় মহুয়া স্বীকার করে নেয় সে তাঁর দুই ছেলে আরিত্র ও অনিকেত কে সঙ্গে নিয়ে প্রৌঢ় অভিজিৎ যশ ও ছবি যশকে খুন করেছে।খুনের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষনের জন্য ’ফরেনসিক টিম’ কে ডাকা হয়েছে বলে পুলিশ সুপার জানিয়েছেন।।