প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৩ নভেম্বর : এ যেন উলট পুরান কাণ্ড। আবাস যোজনার পাকা বাড়ি পেয়েও নিতে চাইছেন না শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধিরা ! এই ত্যাগের কথা তারা বিডিওকে জানিয়েও দিচ্ছেন । এমনটা জেনে হয়তো অনেকেই বিষয়টিকে গল্প কথা ভাবতে পারেন। কিন্তু না,বাস্তবেই ’ত্যাগের’ এমন নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন শাসক দলের পূর্ব বর্ধমান জেলা কয়েক জনপ্রতিনিধি।তা জেনে বিরোধীরা কটাক্ষ,এসব তৃণমূল কংগ্রেস দ্বারা রচিত ও নির্দেশিত ’গিমিক’ ছাড়া আর কিছু নয় ।
আবাস প্রাপকদের নামের তালিকা ধরে যাচাই প্রক্রিয়া শুরু হতেই রাজ্যের জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভ বিক্ষোভ।এমন আবহে তৃণমূল পরিচালিত কেতুগ্রাম ২ ব্লকের গঙ্গাটিকুরি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান গোপাল হাজরার নাম আবাস যোজনার তালিকায় নথিভুক্ত থাকার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।পাকাবাড়ি থাকা সত্ত্বেও গোপাল হাজরার নাম আবাসের তালিকায় থাকা নিয়ে সমালোচনার বন্যা বইতে শুরুকরে।এমত অবস্থায় বিতর্ক এড়াতে প্রধান গোপাল হাজরা ব্লকের বিডিওকে লিখিত ভাবে জানিয়ে দেন,’তিনি সরকারী আবাস যোজনার পাকা বাড়ি নেবেন না’।
এমন ত্যাগের নিদর্শন শুধু যে গঙ্গাটিকুরি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান দেখিয়েছেন এমনটা নয়। একই পথে হেঁটে ত্যাগের নজির সৃষ্টি করেছেন গলসি ২ ব্লকের মসজিদপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ও এক সদস্য এবং কাটোয়া ১ ব্লকের খাজুরাডিহি গ্রাম পঞ্চায়েতের দুই সদস্য। এঁরা সবাই নিজের নিজের ব্লকের বিডিওকে জানিয়ে দিয়েছেন ,’ সরকারী আবাস যোজনার তালিকায় নাম থাকলেও তাঁরা আবাসের পাকা বাড়ি নেবেন না’। সরকারী আবাস যোজনার বাড়ি নিতে না চাওয়ার কারণ,এলাকার গরিব মানুষের জন্য স্বার্থত্যাগ বলেই জানিয়েছেন এই জনপ্রতিনিধিরা।
খাজুরাডিহি গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য ভবতোষ দেবনাথ এবং অপর সদস্য রজনী সরকারের স্ত্রী শ্যামলী সরকারের নাম এবারের আবাস যোজনার তালিকায় জ্বলজ্বল করছিল। তা নিয়ে এলাকায় জোর সমালোজনা শুরু হয়। তার পরেই ত্যাগ স্বীকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন শাসক দলের প্রতীকে নির্বাচিত এই দুই পঞ্চায়েত সদস্য ।তারা ব্লকের বিডিওকে তাঁদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েও দেন ।
এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ প্রসঙ্গে মসজিদপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান মুন্সি মাণ্ডি ও দুই পঞ্চায়েত সদস্যের সাফাই,’২০১৮ সালে যখন সার্ভে হয়েছিল তখন তাঁদের মাটির বাড়ি ছিল।যদিও ধারদেনা করে পরে তাঁরা পাকা বাড়ি তৈরি করে নিয়েছেন।পুরানো সেই তালিকার সূত্র ধরেই হয়তো ২০২৪ সালের আবাসের তালিকায় ফের তাঁদের নাম ওঠে। কিন্তু এলাকায় অনেক গরীব মানুষ আছেন,যাঁরা কাঁচা বাড়িতে বসবাস করেন। তাই তাঁরা চান ওই গরিব মুনুষগুলি আগে বাড়ি পাক। তার পর তাঁরা বাড়ি নেবেন নাকি ভাববেন বলে জানান । একই সাফাই দিয়েছেন মসজিদপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য আজমিরা বেগম।
এ নিয়ে বিরোধীরা কাটাক্ষ করলেও গরিব মানুষের স্বার্থে পঞ্চায়েত প্রধান মুন্সি মাণ্ডি ’ত্যাগের’ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বলে এলাকাবাসী দাবি করেছেন।তাঁরা বলেন,মসজিদপুরর পঞ্চায়েতের প্রধান মুন্সি মাণ্ডির বাড়ি গলসির ঘটিংঘাটা গ্রামে।মাটির দেওয়াল আর এ্যাসবেস্টের চালার বাড়িতে তিনি স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন। ২০২২ সালের তালিকা ধরে এবার ভেরিফিকেশনের কাজ হয়।২২ শের তালিকাতেও পঞ্চায়েত প্রধান মুন্সি মাণ্ডির নাম আবাসের তালিকায় ছিল । প্রধান সরকারী আবাস যোজনার পাকা বাড়ির প্রাপ্যদার। তবুও এলাকার গরিব মানুষের কথা ভেবে তিনি নিজে ত্যাগ স্বীকার করেছেন ।সরকারী আবাস যোজনার পাকা বাড়ি নেবেন না বলে তিনি বিডিওকে ইতিমধ্যে জানয়েও দিয়েছেন। একজন পঞ্চায়েত প্রধানের এমন ত্যাগ স্বীকার নজিরবিহীন বলে মসজিদপুরর অঞ্চলের মানুষজন দাবি করেছেন।
যদিও পঞ্চায়েত প্রধানের আবাস যোজনার বাড়ি নিতে না চাওয়ার বিষয়টিকে ’ত্যাগ স্বীকার’ বলে মানত চাননি বিজেপি নেতৃত্ব । গলসির বিজেপি নেতা শান্তরূপ দে এ নিয়ে অভিযোগে জানান,
“পঞ্চায়েত প্রধানের মা তো সরকারি আবাস প্রকল্পে বাড়ি পেয়ে গিয়েছেন।তাহলে একই বড়ির সদস্য হয়ে প্রধান কি করে আবার সরকারী আবাসের বাড়ি পেতে পাবেন ? বিজেপি নেতা শান্তরূপ দে পরিস্কার জানিয়ে দেন,এখানে ত্যাগের কিছু নেই। এসব রাজনৈতিক গিমিক ছাড়া আর কিছু নয়।
আর জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন,’দলের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে যদি কোনও জনপ্রতিনিধির এই আবাসের তালিকায় নাম আসে তাহলে যেন তারা সেই নাম বাদ দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। জনপ্রতিনিধি রজনী সরকার ,মুন্সি মাণ্ডি প্রকৃতই গরিব মানুষ ।’ তবুও বিবেকের তাড়না এবং দলীয় নির্দেশ এই দুইয়ের কারণেই কেতুগ্রাম ও গলসির পঞ্চায়েত প্রধান সহ তিন পঞ্চায়েত সদস্য সরকারী আবাসের তালিকা থেকে তাঁদের নাম কাটিয়ে দিয়েছেন ।।