নজরুলের গানের সুর নজরুল নিজেই করতেন। তবে মাঝে মাঝে তিনি গান লিখে তা তার স্নেহধন্য কাউকে কাউকে দিয়ে সুর করাতেন। আর সেক্ষেত্রে কমল দাশগুপ্ত ছিলেন তার প্রথম পছন্দ। কমল দাশগুপ্তের চেয়ে বেশি কেউ নজরুলের গানের সুর করেননি। কমল একাই প্রায় ১৫০, কারো মতে ২০০ বা মতান্তরে ৪০০টি নজরুলের গানের সুর করেছেন। নজরুলের গান অসম্পূর্ণ কমল দাশগুপ্তের সুর ছাড়া। ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন’ , ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে তোমারে করেছে রানী’, ‘এই কিগো শেষ দান বিরহ দিয়ে গেলে’, ‘পৃথিবী আমারে চায় রেখোনা বেঁধে আমায়’, ‘যেথা গান থেমে যায়’ , ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘আমি বনফুল গো ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে’, ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’, ‘কতদিন দেখিনি তোমায়, হার মেনেছি গো হার মেনেছি’, ‘জানি জানি গো মোর শূন্য হৃদয় দেবে ভরি’, ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে’, ‘পথহারা পাখি কেঁদে মরে একা’, ‘গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়’, প্রভৃতি জনপ্রিয় নজরুল গীতির সুরকার ছিলেন কমল দাশগুপ্ত । এই কিংবদন্তি কমল দাশগুপ্ত সেই ১৯৪৬ সালে ৩৭ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছেন,যিনি গাড়ি ছাড়া কলকাতার রাস্তায় পা রাখেননি,কিন্তু তার শেষ জীবন কেটেছে নিদারুন দুর্দশার মধ্যে ৷ শেষ জীবনে অন্ন সংস্থানের জন্য তাকে মুদির দোকা চালাতে হয়েছে । অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে তার ।
কমল দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৭৪) একাধারে কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। ১৯১২ সালের ২৮ জুলাই নড়াইল জেলায় তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত ছিলেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের অনুরাগী। পুরো নাম কমলপ্রসন্ন দাশগুপ্ত হলেও তিনি কমল দাশগুপ্ত নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন । পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম হলেও কমল দাশগুপ্তের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতায়। ১৯২৮ সালে তিনি ক্যালকাটা একাডেমী থেকে ম্যাট্রিক এবং পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিকম পাস করেন । মীরার ভজনে সুরের প্রয়োগ বিষয়ে গবেষণা করে তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব মিউজিক ডিগ্রি (১৯৪৩) লাভ করেন।
কমল দাশগুপ্তের সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় সহোদর বিমল দাশগুপ্তের কাছে । পরে দিলীপকুমার রায়, কানা কেষ্ট, ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁ প্রমুখের কাছে তিনি সঙ্গীত শিক্ষা করেন। তিনি আধুনিক বাংলা, উর্দু, হিন্দি,ঠুংরি এবং ছায়াছবির সঙ্গীতে কণ্ঠদান ও সুরারোপ করেন। সুরের রাজ্যে কমল দাশগুপ্ত ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁর সুরের ভিত্তি রাগ এবং ঠুংরি ছিল তাঁর সুর রচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। এর সঙ্গে বাংলা গানের নানা ধারাকে তিনি ভেঙ্গে-গড়ে মিশিয়ে দিয়েছেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের সুরকার হিসেবেও কমল দাশগুপ্ত খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর সুর দেওয়া ও গাওয়া ‘তুফান মেল’, ‘শ্যামলের প্রেম’, ‘এই কি গো শেষ দান’ চলচ্চিত্রের এ গানগুলি এককালে ভীষণ জনপ্রিয় ছিল । অনেক হিন্দি ছায়াছবিতেও তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তিনি প্রায় ৮০টি ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। আমেরিকার ওয়ার প্রপাগান্ডা ছবির নেপথ্য সঙ্গীতেও তিনি কাজ করেন। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর শেষ ছবি ‘বধূবরণ’ ।
কমল দাশগুপ্ত নজরুলের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেন এবং প্রায় চারশ নজরুলসঙ্গীতে সুরারোপ তাঁর শিল্পীজীবনের এক বিরাট কৃতিত্ব। তাঁর সুরারোপিত গানের সংখ্যা প্রায় আট হাজার। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁর মৌলিক অবদান স্বরলিপির শর্টহ্যান্ড পদ্ধতির উদ্ভাবন এবং আকারমাত্রিক পদ্ধতি ও স্টাফ নোটেশন পদ্ধতির স্বরলিপি স্থাপন। এছাড়া কমল দাশগুপ্ত গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে গ্রামোফোন ডিস্কে তাঁর সুরে গাওয়া বহু গান অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। সেসবের মধ্যে ‘সাঁঝের তারকা আমি’, ‘আমি ভোরের যূথিকা’ প্রভৃতি গান আজও জনপ্রিয়।
কিন্তু কবি নজরুলের সঙ্গে সঙ্গীত চর্চা করার সময়ে প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের প্রেমে পড়ে খ্যাতির চুড়া থেকে মাটিতে এসে পড়েন কমল দাশগুপ্ত ৷ ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করবার শর্ত ছিল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা । ১৯৫৫ সালে নজরুলের ছাত্রী ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করেন কমল দাশগুপ্ত। বিয়ের ৪ বছর পর ধর্মান্তরিত হয়ে গ্রহণ করেন ইসলাম । কমল দাসগুপ্ত থেকে হয়ে যান কামাল উদ্দিন আহমেদ । আর তারপর থেকেই তার অধঃপতন শুরু হয় । পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান । যদিও খ্যাতির শীর্ষে থাকায় এতে তার তেমন কোনো সমস্যা হয়নি । কিন্তু যে কমল দাশগুপ্ত নজরুলের ৩ শতাধিক গানসহ সারা জীবনে ৮ হাজার গানে সুরারোপ করেছেন। ১৯৪৬ সালে যে কমল দাশগুপ্ত সেই সময়ের সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছিলেন। সেই কমল দাসগুপ্ত এক সময় দেউলিয়া হয়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন। জীবিকার তাগিদে খুলতে হয়েছিল মুদির দোকান । মৃত্যু হয়েছিল চূড়ান্ত অবহেলায় ও একপ্রকার বিনা চিকিৎসায়।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের প্রথম ভাগে কমল দাশগুপ্তের এতটাই জনপ্রিয়তা ছিলেন যে, মাসে গড়ে ৫০টি গানে সুর দিতেন। তখন তার পারিশ্রমিকও ছিল আকাশচুম্বী । জানা যায়,১৯৪৬ সালে মোট ৩৭ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত। গাড়ি ছাড়া চলার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না । তাকেই পরবর্তী কালে চরম দারিদ্রের মুখোমুখি হতে হয়েছিল ।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে নাথ ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে একমুহূর্তেই সমস্ত জমানো অর্থ হারান কমল দাশগুপ্ত । এদিকে ততদিনে কাজও কমে গেছে ৯০ ভাগ। ইতিমধ্যে মরফিনের নেশা ধরেছেন, যার প্রভাবে ভয়াবহ পেটের যন্ত্রণার জন্য ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত ইনজেকশন নিতে হতো। আর্থিক ও মানসিকভাবে কমল দাশগুপ্ত তখন চরমভাবে বিপর্যস্ত।
১৯৬৭ সালে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। জীবিকার তাগিদে তাকে ঢাকার হাতির পুলে মুদির দোকান খুলতে হয়েছিল। একবার পত্রিকার প্রতিবেদনে তার দুরবস্থার কথা উঠলে বাংলাদেশ বেতারের গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী শহীদুল ইসলামের চেষ্টায় বেতারে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বিভাগে প্রধান সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাকে। বাংলা একাডেমি থেকে তখন বের হয়েছিল ফিরোজা বেগমের ‘নজরুল গীতিমালা’। স্বরলিপির শর্টহ্যান্ড পদ্ধতির উদ্ভাবকও ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। ফিরোজা বেগমের সেই বইতে স্বরলিপির চিহ্ন তৈরি করেছিলেন। একটা পর্যায়ে ফের আগের অসুস্থতা ফিরে আসে কমল দাশগুপ্তের। শারীরিক অবস্থা হয়ে উঠে শোচনীয়। মরফিনের নেশা আর শারীরিক দুরবস্থার কারণে তখন চাকরি ছেড়েছিলেন। একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় আর চূড়ান্ত অবহেলায় ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই চিরতরে চলে গিয়েছিলেন এই অনন্য প্রতিভাবান শিল্পী। রেখে গিয়েছিলে তিন পুত্র তাহসিন আহমেদ,হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদকে ।
কমল দাসগুপ্তের তাঁর তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ বাংলাদেশের প্রখ্যাত রক ব্যান্ড ‘মাইলস’ চালায়। তবে সবথেকে বড় বিড়ম্বনা হলো এই দুই ছেলে কিন্তু প্রচন্ড ভারত বিরোধী এবং হিন্দু বিরোধী। শাফিন আহমেদ যদিও সম্প্রতি মারা গিয়েছে। ফেসবুকে ভারতকে ছাপার অযোগ্য ভাষা লিখে নানাভাবে ঘৃণার ভাষায় তাচ্ছিল্য করবার জন্যে কলকাতায় একবার তাদের সাথে অনুষ্ঠান করতে অস্বীকার করে কলকাতার বাংলা ব্যান্ড ‘ফসিলস’। ফিরোজা বেগমও ছিলেন প্রতিভাময়ী সঙ্গীতশিল্পী । তিনি ছিলেন কট্টর ইসলামি৷ অন্যদিকে নিজ ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন কমল দাশগুপ্ত । হিন্দু বাবার পুত্র হয়েও কমল দাশগুপ্তর ছেলেরা হয়ে যায় চরম হিন্দু ও ভারত বিদ্বেষী ।।