ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থীদের মুখে আমরা শুনতে অভ্যস্ত যে প্রভু শ্রীরাম একটা কাল্পনিক চরিত্র । আর রামায়ন হল রূপক কাহিনী । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–’রামায়ণ মহাভারত কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে; ঘটনাবলির ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময় বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে। রামায়ণ মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস।’ বস্তুত ভারতীয়রা সে সময় দর্শন, ভূগোল, গণিত, বিজ্ঞান নিয়ে প্রভূত চর্চা করলেও সাল-তারিখ সহ ইতিহাস চর্চা শুরু করেননি। তবে সাল-তারিখ না-থাকলেও বাল্মীকির রামায়ণে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে রকমভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভৌগোলিক স্থানের বিবরণ আছে এবং প্রায় সমস্ত ঘটনার তিথি-নক্ষত্রের উল্লেখ আছে, তাতে এ গ্রন্থকে ইতিহাস না-বলে উপায় নেই।
এখন আসা যাক রামায়নের দেবী সীতাকে অপহরণের বর্ণনায় । রাবণ যখন সীতাকে অপহরণ করে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিলেন তখন তার পুষ্পক বিমানের পথ কী ছিল? কী বৈজ্ঞানিক রহস্য লুকিয়ে আছে সেই অনুচ্ছেদে ? লক্ষ লক্ষ বছর আগে সেই পথটি কীভাবে পরিচিত ছিল এই প্রশ্নের উত্তর বামপন্থী ইতিহাসবিদদের কাছ থেকে আশা করা বাতুলতা মাত্র । আসলে, রাবণ পঞ্চবটি (নাসিক, মহারাষ্ট্র) থেকে মা সীতাকে অপহরণ করে হাম্পি (কর্নাটক), লেপাক্ষী (অন্ধ্রপ্রদেশ) হয়ে পুষ্পক বিমান হয়ে শ্রীলঙ্কায় পৌঁছেছিলেন। আশ্চর্য লাগে যখন আমরা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে দেখি যে নাসিক, হাম্পি, লেপাক্ষী এবং শ্রীলঙ্কা একটি সরলরেখায় রয়েছে । অর্থাৎ পঞ্চবটি থেকে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ছোট পথ এটি।
এবার চিন্তা করুন, সেই সময় কোন গুগল ম্যাপ ছিল না যেটি সবচেয়ে ছোট রাস্তা বলতে পারতো, তাহলে সেই সময় লেখিক কিভাবে খুঁজে পেলেন কোনটি সবচেয়ে ছোট এবং সরাসরি রাস্তা ?
অথবা ভারত বিরোধীদের অহংকার মেটানোর জন্য যদি মেনে নিই যে রামায়ণ বাল্মীকির লেখা একটি রূপক কাহিনী, তাহলে বলুন তো সেই সময়ে গুগল ম্যাপও ছিল না, তাহলে বাল্মীকি কীভাবে রামায়ণে বর্ণিত পঞ্চবটি থেকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যুক্ত সরাসরি ছোট পথ কোনটি ছিল তিনি জানলেন কি করে ? মহাকাব্যে, ঘটনা বর্ণনা করার জন্য তিনি যেকোনো স্থানের উল্লেখ করতে পারতেন । কিন্তু তিনি লঙ্কা যাওয়ার ওই সংক্ষিপ্ত আকাশ পথকেই বেছে নিয়েছিলেন । কিন্তু কেন বাল্মীকি দেবী সীতাকে অপহরণ করার জন্য শুধুমাত্র সেই স্থানগুলি উল্লেখ করেছিলেন যেগুলি পুষ্পক বিমানের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত এবং সবচেয়ে প্রত্যক্ষ পথ ছিল ? একই রকমভাবে কীভাবে ৫০০ বছর আগে, গোস্বামী তুলসীদাস তাঁর রচিত হনুমানচালিসায় পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কী বলেছিলেন ? (যুগ সহস্ত্র জোজন পার ভানু হিসাব করে), যখন নাসা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই দূরত্ব আবিষ্কার করেছে।★★
উল্লেখ্য যে পঞ্চবটি হল সেই স্থান যেখানে ভগবান শ্রী রাম, মা জানকী এবং ভাই লক্ষ্মণ তাদের বনবাসের সময় বাস করছিলেন। এখানে শুপর্ণখা এসে লক্ষ্মণকে বিয়ে করার জন্য ঝামেলা শুরু করে… বাধ্য হয়ে লক্ষ্মণ শুপর্ণখার নাক কেটে দেয় এবং আজ আমরা এই জায়গাটিকে নাসিক (মহারাষ্ট্র) হিসাবে জানি।
আরও দেখা যাক,পুষ্পক বিমানে যাওয়ার সময় দেবী সীতা নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন পাহাড়ের চূড়ায় বসে থাকা কিছু বানর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে, তখন সীতা তার পোশাকের মূল অংশ ছিঁড়ে তার চুড়ি বেঁধে নিচে ফেলে দিলেন,যাতে রামের তাকে খুঁজে পেতে কাজে লাগে । সীতাজী যে জায়গায় এই অলঙ্কারগুলি ঐ বানরদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করেছিলেন সেটি হল ‘ঋষ্যমুক পর্বত’ যা আজকের হাম্পি (কর্নাটক) এ অবস্থিত।
এরপর…বৃদ্ধ শকুন রাজা জটায়ু কাঁদতে কাঁদতে সীতার দিকে তাকালেন এবং দেখলেন যে একটি রাক্ষস একটি মহিলাকে জোর করে তার বিমানে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সীতাকে মুক্ত করতে জটায়ু রাবণের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। রাবণ তার তরবারি দিয়ে জটায়ুর ডানা কেটে দিলে । এরপর সীতার খোঁজে রাম ও লক্ষ্মণ যেখানে রক্তাক্ত জটায়ুর সন্ধ্যান পেয়েছিলেন দক্ষিণের ভাষায় সেই জায়গার নাম ‘লেপাক্ষী’, যেটি আজকেত অন্ধ্রপ্রদেশে,এখন কী বুঝলেন ? পঞ্চবটি… হাম্পি… লেপাক্ষী… শ্রীলঙ্কা…সোজা পথ…সংক্ষিপ্ততম পথ।
ভারতে আজ যারা তাদের জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি ভুলে গেছে, তাদের জানা উচিত যে রামায়ণ কোন পুরাণ নয়। এটাই মহর্ষি বাল্মীকির লেখা প্রকৃত ইতিহাস। যার সব বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আজ পাওয়া যাচ্ছে। অতএব, যখনই কোনো বামপন্থী আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে পুরাণ বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে বা নিজেকে পণ্ডিত বলে পরিচয় দেয়, তখনই তাকে বসিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসা করা দরকার । নিশ্চিত যে তিনি একটিরও উত্তর দিতে পারবেন না । মেকি ধর্মনিরপেক্ষতা আর ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের’ উদ্ভট তত্ত্বে বিশ্বাসী কথিত বামপন্থীদের তখন অস্ত্র হবে যুক্তিহীন তর্ক । বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির যুগে শিক্ষিত সম্প্রদায়কে আর ভুল বোঝানো সম্ভব নয় । কিন্তু শিশুদের ছোট থেকেই নিজের শাস্ত্রকে সম্মান করতে শেখানো কর্তব্য অবিভাবকের । অন্তত তাদের এটা স্মরণ করিয়ে দিন যে এই রামায়ণ কোনও রূপক গল্প নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, যা মুছে ফেলার চেষ্টার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে এতদিন ধরে ।
★★ আধুনিক গণনা অনুসারে : সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে গড় দূরত্ব ১৪৯ মিলিয়ন কিমি বা ৯২ মিলিয়ন মাইল। তুলসীদাস তাঁর হনুমান চালিসায় এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: যুগ-সহস্র-যোজন পর ভানুলিলিও তাহি মধুরা ফল জানু । হনুমান চালিসার উপরের শ্লোক অনুসারে, সূর্য এবং পৃথিবীর মধ্যে দূরত্ব হল: যুগ-সহস্র-যোজন = ১২০০০ x ১০০০ যোজন ।
যোজনা হল দূরত্বের একটি বৈদিক পরিমাপ এবং প্রায় ৮ মাইলের সমান (১৪ শতকের পণ্ডিত পরমেশ্বরের মতে, দ্রগনিতা ব্যবস্থার প্রবর্তক)। এবং ১ মাইল = ১.৬০৯৩৪ কিলোমিটার। হনুমান চালিসায় উপস্থাপিত হিসাব অনুযায়ী সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে দূরত্ব = ১২,০০০ x ১,০০০ যোজন = ৯৬ মিলিয়ন মাইল = ১৫৩.৬ মিলিয়ন কিমি , যা আধুনিক বিজ্ঞানীদের হিসাবের অনেক কাছাকাছি।এখানে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে।যুগ হল সময়ের পরিমাপ এবং যোজন হল দূরত্বের পরিমাপ। এই দুটি কিভাবে একত্রিত করা যেতে পারে?
আমরা দেখতে পাই যে এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানীরাও সময় পরিমাপ (আলোকবর্ষ) ব্যবহার করে দূরত্ব গণনা করতে যা খুব দীর্ঘ। বলা হয় যে সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে প্রায় ৮ মিনিট সময় লাগে।
আলোর বেগ ৩×১০৮ 3 mps হিসাবে গণনা করা হয়। ৮ মিনিটে, আলো ভ্রমণ করে (৩×১০ ৮×৬০×৮) মিটার = ১.৪৪ × ১০ ১১ মিটার = ১.৪৪×১০ ৮ কিমি = ১৪৪ মিলিয়ন কিলোমিটার (যা আধুনিক গণনা অনুসারে সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে দূরত্বের আরেকটি অনুমান) ।
উপরের গণনায় আমরা যে অনুমানগুলি তৈরি করেছি তা নিম্নরূপ:
ভগবদ্গীতা এবং মনু সংহিতার বিবৃতির উপর ভিত্তি করে বৈদিক যুগের সময় গণনা পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে আমরা যুগকে ১২,০০০ নম্বর বোঝাতে অনুমান করেছি। আমরা আনুমানিক ১ যোজন = ৮ মাইল ।
শ্রীল প্রভুপাদ তার উদ্দেশ্য উল্লেখ করেছেন তার উপর ভিত্তি করে। যাইহোক, এটি ৫ মাইল নাকি ৮ মাইল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে এখনও মতভেদ রয়েছে। কিছু অন্যান্য গণনা ৭.৬ মাইল থেকে ৮.৫ মাইল পর্যন্ত মান নির্দেশ করে। কিন্তু এটা আশ্চর্যজনক যে ১৬ শতকের প্রথম দিকে যখন পশ্চিমা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপের সাহায্যে দূরত্ব বের করার চেষ্টা করছিলেন তখন তুলসীদাস এই নির্ভুলতার দূরত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন ।।