শ্যামসুন্দর ঘোষ,মন্তেশ্বর(পূর্ব বর্ধমান),০২ অক্টোবর : জমি নিয়ে বিবাদের জেরে বাড়িতে ঢুকে হামলা, মারধোর এবং মহিলাদের শ্লীলতাহানির করার অভিযোগ উঠল পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি থানার গোহার এক নম্বর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান জিন্নাত আলী শেখ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে । ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার দুপুরে মেমারি থানার বিটরা গ্রাম । আক্রান্ত পরিবারের গৃহবধূ শবরী দাস ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছেন,’আমার শ্বশুরের পূর্ব পুরুষের আমল থেকে বিঘা ৬ জমি চাষ করে আসছে । আনুমানিক ৮০-১০০ বছর ধরে জমিটা ভাগে চাষ করে আসছি আমার । তার মধ্যে মাত্র পাঁচ কাঠা জমি বর্গা দিয়েছে আমাদের ।
পঞ্চায়েত বসিয়ে একটা মিটিং হয়। তখন এই জমির ৫ কাঠা অংশ বর্গা দেওয়ার কথা বলা হয় আমাদের । তা নিয়ে আমরা আদালতে যাই । বর্তমানে ১৪৪ ধারা জারি আছে ওই জমির উপর।’ তিনি বলেন,’গোহার এক নম্বর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান জিন্নাত আলী শেখ দাবি করছেন যে ৮০-১০০ বছর চাষ করলেও জমি বর্গা হয় না । কিন্তু আমরা ব্রিটিশ আমলের নথি আদালতে জমা দিয়েছি । আমার শ্বশুরমশাই মানিক দাস জমির মালিকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন । যাদের জমি তারা নৈহাটিতে থাকে । তারা তলায় তলায় উপপ্রধানদের জমিটা বিক্রি করে দিয়েছে । এতদিনে আমরা তা জানতে পারছি । আমরা আদালতে মামলা করেছি । কিন্তু তারা আদালত কেউ মানছে না। জিন্নাত আলী শেখ বলছেন,আদালত কি করবে ? উপরমহলে আমার যা ক্ষমতা আছে তাতে আদালত কিছু করতে পারবেনা ।’
গৃহবধূ শবরী দাসের অভিযোগ,’শুক্রবার দুপুর সাড়ে বারোটা একটার সময় উপপ্রধানের ৩ ভাই ও ৬ ভাইপোরা মিলে আমাদের বাড়িতে হামলা করে । ঘরের ভেতরে আমার ১২ বছরের ছোট মেয়ে ছিল তাকে ছেঁড়া ছিঁড়ি করেছে । ছোট মেয়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী তার মাথায় লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরেছে । উপপ্রধান,তার ভাই ও ভাইপোরা মিলে আমার বৃদ্ধ শশুর ও শাশুড়িকেও মারধর করেছে । শাশুড়ি হার্টের রোগী, তাকেও লাঠি করে ধরে পিটিয়েছে । আমি পুকুর ঘাটে মাছ ধুচ্ছিলাম, আমাকেও মেরেছে । উপ প্রধানের দাদা মকবুল শেখ আমার ১৯ বছরের মেয়ের হাত ধরে টানাটানি করেছে এবং তার শ্লীলতাহানি করেছে । ছোট মেয়েকে বাঁশে করে এমন মেরেছে যে তাকে বর্ধমানের অনাময় হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হয়েছে ।’
পেশায় টোটো চালক বধূর স্বামী রাজু দাসের কথায়,’আমার বাবা, মা, স্ত্রী এবং ছোট মেয়েকে মারধোরে তো করেছেই, আমার বড় মেয়ে মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করছিল । সেজন্য তার মোবাইলটা কাড়তে তার জামার বুকের কাছে টানাটআনি করেছে এবং ছেড়াছেড়ি করেছে । জামা ছিঁড়ে দিয়েছে ।’
আক্রান্ত পরিবারের বক্তব্য শুনুন 👇
জানা গেছে, যে ৬ বিঘা জমি নিয়ে বিবাদ বর্তমানে সেই জমির কাগজ-কলমে মালিক হলেন অনিমা সরকার নামে জনৈক এক মহিলা । কিন্তু তিনি বিটরা গ্রামে থাকেন না । জমিটি দীর্ঘ প্রায় ৮০ বছর ধরে চাষবাস করে আসার দাবি করছেন মানিক দাসরা । জিন্নাত আলি শেখ ওই ছবিটা জমি কিনে নিয়েছেন বলে দাবি করে দখল নিতে গেলে বিবাদ এর সূত্রপাত বলে জানা গেছে । পঞ্চায়েতে এনিয়ে সালিশিসভাও ডাকা হয় । কিন্তু মানিক দাসরা দাবি করে যে বর্গা আইনে ওই জমির দখলসত্ত্ব তাদের । শেষ পর্যন্ত ওই ৬ বিঘা জমির মধ্যে মানিক দাসকে ৬ কাঠা জমির পাট্টা করে দিয়ে বিবাদের নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিল পঞ্চায়েত । কিন্তু এই পঞ্চায়েতের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি মানিক দাসরা । পরিবার প্রশ্ন তুলছে, জমিটি যদি এক নম্বর খতিয়ানের অন্তভূর্ক্ত হয় তাহলে কি করে সেই জমি কিনলো উপপ্রধান জিন্নাত আলি শেখ ? আর যদি বর্গা হয় তাহলে আইন অনুযায়ী গোটা জমির দখলসত্ত্ব তাদের পরিবারের হওয়া উচিত । কারন তারাই বংশ পরম্পরায় জমিটি চাষবাস করে আসছেন । এখানে কোনো ভাবেই জিন্নাত আলি শেখের নাম আসে না । তাহলে কিসের ভিত্তিতে জিন্নাত আলি শেখ ওই জমির মালিকানা দাবি করছেন ? কারন এক নম্বর খতিয়ান তালিকাভুক্ত জমির কেনাবেচা হয়না ।
এ নিয়ে ওইদিনই থানায় জিন্নাত আলি শেখসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে আক্রান্ত পরিবার । শুক্রবার মেমারি থানায় দায়ের করা অভিযোগে শবরী দাসের ১৯ বছরের তরুণী বর্ষা দাস পুলিশকে জানিয়েছেন,’আজ আনুমানিক বেলা ১২ টা নাগাদ সাহাদত শেখের ছেলে মগুল আলী শেখ দুষ্কৃতী বাহিনী নিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে হামলা চালায় । মগুল আলী শেখ আমার শ্লীলতাহানি করতে যায় এবং বাঁশ দিয়ে মেরে আমার বোনের মাথায় মারে । আমার মা ও দাদুকে ও মারে ।’ অভিযোগপত্রে তিনি এক নম্বরে সাহাদত শেখের ছেলে জিন্নাত আলী শেখকে আসামি করেছে । দুই নম্বরে আসামি করেছেন জিন্নাত আলী শেখের ভাই আমের আলী শেখ, তিন নম্বরে রয়েছে আমের আলী শেখের ছেলে প্রতিক আলী শেখ, ৪ নম্বরে শফিক শেখ এবং ৫ ও ৬ নম্বর আসামির তালিকায় রাখা হয়েছে ঘোষিক শেখ এবং শাহাবুদ্দিন সেখ নামে এক ব্যক্তিকে ।
অভিযোগকারী আক্ষেপ করে লিখেছেন, জিন্নাত আলী শেখ একজন প্রধান হয়েও সে তার ভাইদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে মা ও দাদুকে মারধর করে । আমি একজন কুমারী মেয়ে আমারও শ্লোলতা হানি করতে যায় । খুন করবে বলে হুমকি দিয়ে যায় আমাদের । এই মুহূর্তে আমরা ওই গুন্ডা বাহিনীর দ্বারা খুনের আশঙ্কা করছি । সেই সময় আমি ছুটে পালিয়ে গিয়ে পাশের বাড়িতে আত্মগোপন করি । আমাদের ওই প্রতিবেশী বাড়ির সদস্যদেরও খুনের হুমকি দেয় জিন্নাত আলী শেখ ।’
জানা গেছে,এই ঘটনায় রাতেই একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ । আজ শনিবার তাকে আদালতে পাঠায় পুলিশ । যদি অভিযোগ প্রসঙ্গে গোহার এক নম্বর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান জিন্নাত আলি শেখ ফোন রিসিভ না করায় কোনো মতামত পাওয়া যায়নি । তবে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন,পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের তৃণমূলের মেন্টর ইসলাম শেখ । তিনি বলেছেন,’এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে জিন্নাত আলি শেখ এলাকায় কার্যত ত্রাসের সৃষ্টি করে রেখেছেন।’ তিনি দলীয় নেতা ও তার দলবলের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি করারও অভিযোগ তুলেছেন । স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ যে মাস দুয়েক আগে জিন্নাত আলি শেখের গুন্ডাবাহিনী একই পঞ্চায়েত এলাকার মহিষডাঙ্গায় মারধর ও ভাঙচুর চালায় ।।