পাকিস্তান অধিকৃত বালুচিস্তানে মরুতীর্থ হিংলাজ মাতার মন্দির ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম । এই মন্দির হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান । এই তীর্থস্থান সম্পর্কে হিংলাজ পুরাণ তথা বামন এবং অনেক পুরাণেও বর্ণনা রয়েছে । করাচি থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের এই মন্দিরকে ঘিরে নানা মিথ রয়েছে। মন্দিরের ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে রয়েছে রহস্য । এই মন্দিরে মাথা নোয়ান হিন্দু -মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ । ‘ননী কা মন্দির’ নামেও পরিচিত মাতা হিংলাজ । এখানকার ভৈরব হলেন শিবহারকরয় । এখানেই দেবী সতীর মাথা ও অলঙ্কার পড়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয় । এই মন্দিরের সাথে যুক্ত আরেকটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে। কথিত আছে যে প্রতি রাতে সমস্ত শক্তি এই স্থানে একত্রিত হয়ে রাসলীলা করেন এবং দিনের বেলা হিংলাজ মায়ের মধ্যে মিশে যান৷ জনশ্রুতি হল যে প্রভু শ্রী রামও এসেছিলেন এখানে । শ্রীরামের খোদাই করা লিপি আজও বিরাজমান এখানে । হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসারে, ভগবান পরশুরামের পিতা মহর্ষি জমদগ্নি এখানে তপস্যা করেছিলেন। তাঁর নামানুসারে আসারাম নামে একটি জায়গা এখনও এখানে রয়েছে। গুরু গোরক্ষনাথ, গুরু নানক, দাদা মাখনের মতো মহান আধ্যাত্মিক সাধকরা এই বিখ্যাত মন্দিরে মায়ের পূজা করতে এসেছেন বলে কথিত আছে ।
‘ভগবান পরশুরাম’ ২১ বার নিঃক্ষত্রিয় করার পর কথিত আছে যে অবশিষ্ট রাজারা মা হিঙ্গুলার আশ্রয়ে গিয়ে তাদের সুরক্ষার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তখন মা তাদেরকে ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’ স্বীকৃতি দেওয়ায় তারা পরশুরামের কঠোর কুঠারের আক্রমণ থেকে তারা বেঁচে যান বলে শাস্ত্রে উল্লেখ আছে । এখানে আসামের কামাখ্যা, কন্যাকুমারী ও তামিলনাড়ুর কাঞ্চির কামাক্ষী, গুজরাটের আম্বাজি, প্রয়াগের ললিতা, বিন্ধ্যাচলের বিন্ধ্যবাসিনী, কাংড়ার আগ্নেয়গিরি, বারাণসীর বিশালাক্ষী, গয়ার মঙ্গলাদেবী, বাংলার সুন্দরী, নেপালের গুহ্যেশ্বরী যোগ রয়েছে বলে মনে করা হয়।
কিংবদন্তি অনুসারে, যখন ভগবান শিব দেবী সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে ‘তান্ডব’ করতে শুরু করেছিলেন তখন ভগবান বিষ্ণু মহাবিশ্বকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে মৃতদেহটিকে ৫১ টি অংশে কেটেছিলেন। বিশ্বাস করা হয় যে হিংলাজ সেই স্থান যেখানে দেবীর মস্তক পড়েছিল। এই মন্দিরের সাথে যুক্ত আরেকটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে। যা হল দেবী হিংলাজের মাথা নিচু করা থাকে । ভগবতীর চুলের বিভাজন কুমকুম (হিংলু) দ্বারা সজ্জিত ছিল। তাই একে হিংলাজ/হিঙ্গুলা শক্তিপীঠ বলা হয়।
এই পবিত্র শক্তিপীঠটি পাকিস্তানের করাচি থেকে ২১৭ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান এলাকার হিংগোল নদীর তীরে হিংলাজ এলাকায় অবস্থিত। বেশিরভাগ যাত্রা মরুভূমির মধ্য দিয়ে করতে হয়, যা অত্যন্ত কঠিন। স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান ভারতের অংশ ছিল। হিংলাজ হল পাকিস্তানের দুটি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি যা ভারত সীমান্তের ওপারে এবং পাকিস্তানে অবস্থিত। পাকিস্তানের অপর শক্তিপীঠটি হল শিবহরকরায় । পাকিস্তানের বালুচিস্তানের লাসবেলায় মাকরান উপকূলের কাছে গিরিখাতে থাকা হিংগোল নদীর তীরে একটি পার্বত্য গুহায় দেবী দুর্গার বিশেষ রূপ হিংলাজ মাতার পূজাবেদিটি অবস্থিত।
হিংলাজ মাতার মাটির নির্মিত নিচু পূজাবেদিটি একটি ছোট প্রাকৃতিক গুহার মধ্যে অবস্থিত। এই বেদিতে দেবীর কোনও মূর্তি নেই। একটি ক্ষুদ্র অনিয়তাকার পাথরকে হিংলাজ মাতা হিসেবে পূজা করা হয়। হিংলাজের মন্দিরটি একটি গুহার মধ্যে অবস্থিত৷ এটি আসলে একটি প্রাকৃতিক গ্যাসের অগ্নিকুণ্ড৷ অগ্নিজ্যোতিকেই হিংলাজদেবীর রূপ বলে মানা হয় ৷ পাকিস্তানে অলিখিত ইসলামি শরিয়া শাসন লাগু হওয়া এবং ইসলামি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির বাড়বাড়ন্তের কারনে বর্তমানে এখানে খুব কম পর্যটক আসেন ৷ পাথরটি সিঁদুর মাখানো থাকে। তা থেকেই সম্ভবত এই অঞ্চলের সংস্কৃত নাম হিঙ্গুলার উৎপত্তি এবং এই হিঙ্গুলা শব্দটি থেকেই বর্তমান নাম হিংলাজের উদ্ভব ঘটে।দেবীর নাম হিংলাজ হলেও মূল সংস্কৃত শব্দটি হল “হিঙ্গুলা”৷ এটিকে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বিষের ঔষধ বা অ্যান্টিভেনাম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তীর্থযাত্রীরা সেকালে যেতেন উটের পিঠে চড়ে৷ যাত্রা শুরু হত করাচী শহরের কাছে হাব নদীর ধারে৷ সঙ্গে থাকত এক মাসের রসদ, যেমন শুকনো খাবার, মরুদস্যুদের প্রতিরোধ করার জন্য অস্ত্র, পানীয় জল ইত্যাদি৷ এছাড়া সঙ্গে থাকত হিংলাজ মাতার প্রসাদের জন্য শুকনো নারকেল, মিছরি, বাতাসা ইত্যাদি৷ এক মাসের অত্যন্ত কঠোর যাত্রার পর শ্রান্ত তীর্থযাত্রীরা পৌঁছতেন হিংলাজে৷ অঘোর নদীতে স্নান সেরে তাঁরা দর্শন করতে যেতেন হিংলাজ মাতাকে৷ এই মন্দির স্থানীয় বালুচ মুসলমানদের কাছেও পরম আদরণীয়৷ তাদের কাছে এটি “নানী কী হজ” নামে পরিচিত৷
ধর্মীয় উৎসব
মরুতীর্থ হিংলাজ মন্দিরে প্রতি বছর এপ্রিল মাসে একটি ধর্মীয় উৎসব হয়, যেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিশেষ করে হিন্দুরা আসেন। হিঙ্গুলা দেবীর দর্শনের জন্য পাসপোর্ট এবং ভিসা আবশ্যক ।
দেবীর চুল
বিশ্বাস করা হয় যে একবার এখানে দেবী আবির্ভূত হয়ে বর দিয়েছিলেন যে আমার চুল পরিক্রমাকারী ভক্তের প্রতিটি ইচ্ছা পূরণ হবে। চুল হল এক ধরনের প্রবাল ঘের জায়গা যা মন্দিরের বাইরে ১০ ফুট লম্বা জ্বলন্ত আগুন দিয়ে পূর্ণ একটি স্থান, যার উপর দিয়ে সন্তানহীনরা মন্দিরে যান । অলৌকিক ভাবে পঞ্চধারীরা শুধুমাত্র সামান্য ব্যথা অনুভব করেন কিন্তু শরীরের কোন ক্ষতি হয়না । তবে ব্রত পালনকারীর মানত অবশ্যই পূর্ণ হয় ।
এখানকার মন্দিরটি একটি গুহা মন্দির। মাতার দেবতার রূপটি একটি গুহায় বসে আছে যা একটি উঁচু পাহাড়ে নির্মিত। পাহাড়ের গুহায় মাতা হিংলাজ দেবীর মন্দির আছে যার দরজা নেই। মন্দিরের প্রদক্ষিণকারীরা একটি গুহা দিয়ে প্রবেশ করে এবং অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় । মন্দিরের পাশাপাশি রয়েছে গুরু গোরক্ষনাথের চশমা। মাতা হিংলাজ দেবী এখানে সকালে স্নান করতে আসেন বলে বিশ্বাস করা হয়। এখানে মাতা সতী কোটারি এবং ভগবান ভোলেনাথ ভীমলোচন ভৈরব হিসাবে পূজনীয়। মাতা হিংলাজ মন্দির প্রাঙ্গণে শ্রীগণেশ, কালিকা মাতার মূর্তি ছাড়াও ব্রহ্মকুন্ড ও তিরুনকুন্ডের মতো বিখ্যাত তীর্থস্থান রয়েছে। এই আদিশক্তি শুধুমাত্র হিন্দুরা পূজা করে, এবং মুসলমানরাও তাদের দ্বারা অত্যন্ত সম্মানিত । হিংলাজ মন্দিরে প্রবেশ করতে হলে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। মন্দিরে প্রথমে শ্রী গণেশের দর্শন হয়, যিনি সিদ্ধি প্রদান করেন। সামনে, দেবী হিংলাজ দেবীর একটি মূর্তি রয়েছে, যিনি ‘মাতা বৈষ্ণো দেবী’ রূপে রয়েছেন।
যাত্রা শুরু
করাচি থেকে হিংলাজের যাত্রা শুরু। করাচি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে হাউ নদী। প্রকৃতপক্ষে, মূল যাত্রা হাউ নদী থেকে সঞ্চালিত হয়। হিংলাজ যাওয়ার আগে লাসবেলায় দেবীমূর্তি দর্শন করতে হয়। এই দর্শন পুরোহিত দ্বারা করানো হয়। সেখান থেকে তিনি শিব কুন্ডে (চন্দ্রকূপ) যান, যেখানে শ্রদ্ধালু নিজের পাপ ঘোষণা করেন এবং নারকেল অর্ঘ্য দেন। যাদের পাপ মোচন হয়েছে একমাত্র তাদেরই নারকেলের পূজো গ্রহন করেন দেবী এবং তাকে যাত্রার অনুমতি দেওয়া হয়, অন্যথায় নারকেল ফেরত দেওয়া হবে ।
চন্দ্রকূপ
হিংলাজ ‘অগ্নিময় শক্তিপীঠ তীর্থ’ নামেও পরিচিত, কারণ সেখানে যাওয়ার আগে উপাসককে অগ্নি-শ্বাস নেওয়া স্থানে তার গোপন পাপের বিস্তারিত বিবরণ দিতে হয় এবং ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি না করার অঙ্গীকারও করতে হয়। যারা তাদের পাপ লুকিয়ে রাখে তারা আদেশ পায় না এবং তাদের সেখানেই ফেলে রেখে অন্যান্য যাত্রীরা এগিয়ে যায়। এর পর চন্দ্রকূপ দরবারের আদেশ পাওয়া যায়। চন্দ্রকূপ হল তীর্থ পাহাড়ের মাঝখানে উত্থিত একটি উঁচু পর্বত। বিশাল বুদবুদ সেখানে উঠতে থাকে। আগুন দৃশ্যমান নয়, তবে এর ভিতরে একটি ফুটন্ত, বাষ্প-জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে।
কিভাবে মাতা হিংলাজের মন্দির দর্শন করবেন
এই সিদ্ধপীঠে যাওয়ার জন্য দুটি পথ রয়েছে – তার মধ্যে একটি পাহাড় দিয়ে । যাত্রী দল করাচি থেকে লুসবেলা এবং তারপর লাইরি পর্যন্ত হেঁটে যায়। করাচি থেকে ছয়-সাত মাইল দূরে বয়ে চলেছে ‘হাউ’ নদী। এখান থেকেই হিংলাজের যাত্রা শুরু। এখানেই শপথ গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় । যাদের পূজো গ্রহণ হয়না তারা এখান থেকে ফিরে আসেন । এখানেই লাঠির পুজো হয় এবং এখানেই রাতে বিশ্রামের পর সকালে “হিংলাজ মাতা” জপ করে মরুতীর্থের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়। পথে অনেক বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট নালা এবং কূপও পাওয়া যায়। পাশেই মরুভূমিতে শুকনো বর্ষার নদী। এই এলাকার বৃহত্তম নদী হিংগোল, যার কাছাকাছি চন্দ্রকূপ পর্বত রয়েছে। চন্দ্রকূপ এবং হিঙ্গোল নদীর মধ্যে প্রায় ১৫ মাইল দূরত্ব রয়েছে। হিংগোলে, ভক্তরা তাদের মাথায় চুল কেটে এবং যজ্ঞোপবিত পরিধান করে পূজা করেন । এরপর তারা দেবীর স্তোত্রগান গেয়ে তাদের শ্রদ্ধা প্রকাশ করে।
মন্দির দেখার জন্য এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে কারণ সামনে কোন রাস্তা নেই যাতে ট্রাক বা জীপে যাতায়াত করা যায়। মাতা হিংলাজ দেবীর গান গাইতে হিঙ্গোল নদীর পাড় থেকে শ্রদ্ধালুদের হেঁটে যেতে হয় । এরপর আশাপুরা নামে একটি জায়গা আসে, যেখানে ভ্রমণকারীরা বিশ্রাম নেয়। কাপড় পরিবর্তন, স্নান, পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধানের পর পুরানো কাপড় তুলে দেওয়া হয় গরীব-দুঃখীদের হাতে। এর একটু সামনেই কালী মাতার মন্দির। এই মন্দিরে পূজার পর যাত্রীরা হিংলাজ দেবীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ভ্রমণকারীরা পাহাড়ে আরোহণ করে যেখানে মিষ্টি জলের তিনটি কূপ রয়েছে। এই কূপের পবিত্র জল মনকে পবিত্র করে এবং উপাসকদের পাপ থেকে মুক্ত করে।
যাত্রীরা মায়ের গুহার শেষ স্টপে শ্রদ্ধালুরা বিশ্রাম নেয়। পরের দিন, সূর্যোদয়ের আগে, তারা অঘোর নদীতে স্নান করে, সামগ্রী পূজা করে এবং দর্শনে যায়। নদীর ওপারে পাহাড়ে মায়ের গুহা আছে। গুহার কাছে দেবী হিংলাজের একটি প্রাসাদ রয়েছে, যা অতিমানবীয় কারুকার্যের একটি নমুনা, যা যক্ষদের দ্বারা নির্মিত বলে বিশ্বাস করা হয়। একটি একেবারে রহস্যময় স্থান যা একটি পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বাতাস নেই, আলো নেই, তবে অসংখ্য রঙিন পাথর ঝুলছে। সেখানকার মেঝেগুলোও রঙিন—দুই পাহাড়ের মাঝখানে বালুকাময় পথ। কোথাও খেজুর গাছ পাবেন; তারপর কোথাও ঝোপঝাড়ের মধ্যে জলের ফোয়ারা আছে। দেবীর গুহা সব কিছুর বাইরে। মায়ের অশেষ কৃপায় ভক্তরা সেখানে পৌঁছান। কয়েক ধাপ ওঠার পর গুহার প্রবেশদ্বার এসে দৈত্যাকার গুহার শেষ প্রান্তে মাতার বেদিতে প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ড । যা ‘বৈষ্ণো দেবী’-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে হবে। গুহার দুই পাশের দেয়ালকে সংরক্ষিত রূপ দেওয়া হয়েছে। মায়ের গুহার বাইরে একটি বিশাল পাথরে সূর্য ও চাঁদের মূর্তি খোদাই করা আছে। কথিত আছে যে এগুলি প্রভু শ্রীরাম নিজের হাতে খোদাই করেছিলেন।।