লক্ষ্মী মানে শ্রী, সুরুচি। লক্ষ্মী সম্পদ আর সৌন্দর্যের দেবী। বৈদিক যুগে মহাশক্তি হিসেবে তাঁকে পুজো করা হত। তবে পরবর্তীকালে ধনশক্তির মূর্তি নারায়ণের সঙ্গে দেবীকে রাখা হয়। ধন ও সৌভাগ্যের দেবী মা লক্ষ্মী।কোজাগরী পুজোর দিনে, সম্পদের দেবী লক্ষ্মী এবং চন্দ্র দেবতার পুজো করা শুভ। তবে এবার কোজাগরী পুজোর সঠিক তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই বছর কোন তারিখে কোজাগরী পুজো উদযাপিত হবে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, শারদীয়া নবরাত্রির পরের দিন বিজয়াদশমীর পাঁচ দিন পর কোজাগরী পুজোর উৎসব পালিত হয়। তবে এবার কোজাগরী পূর্ণিমার তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। আসুন জেনে নেই কোজাগরী পুজোর সঠিক তারিখ, পুজোর শুভ সময় এবং দেবী লক্ষ্মীর পুজোর পদ্ধতি।
সূর্য সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৪৩১ সালের ২৯ আশ্বিন (১৬ অক্টোবর ২০২৪ ইং ) রাত্রি ০৮ টা ৪০ মিনিট ( বাংলাদেশ সময় ) এর পর থেকে পূর্ণিমা আরম্ভ হয়ে ৩০ আশ্বিন ( ১৭ অক্টোবর ২০২৪ ইং ) সন্ধ্যা বিকাল ০৪ টে ৫৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে, এরপর প্রতিপদ আরম্ভ হবে।অতএব দুই দিনই পূর্ণিমা তিথির অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাহলে, কোনদিন কোজাগরকৃত্য করা উচিত? এই বিষয়ে স্মার্ত আচার্য্যগণের সিদ্ধান্ত কি জানুন :-
“যদা তু পূর্ব্বদিনে নিশীথব্যাপ্তিঃ পরদিনে ন প্রদোষব্যাপ্তিঃ, তদা পূর্ব্বদিনে লক্ষ্মীপূজা কার্য্যা” (স্মৃতিচিন্তামণি, পঞ্চম পুনর্মুদ্রণ, ৮৩ পৃষ্ঠা )। অনুবাদ- যখন পূর্ণিমা পূর্ব্বদিনে অর্দ্ধরাত্র পাইবে ; কিন্তু পরদিনে প্রদোষকালের মুহূর্ত্ত পাইবে না, তখন পূর্ব্বদিনে লক্ষ্মীপূজা করিবে।
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার ক্ষেত্রে নিশীথকাল ও প্রদোষকালের বিচার আবশ্যক। তন্মধ্যে প্রদোষকালের গুরুত্ব সর্বাধিক। প্রদোষকাল সম্বন্ধে স্মৃতিচিন্তামণিকার বৎস ঋষির বচন উদ্ধৃত করে বলেন-‘প্রদোষঽস্তময়াদূর্দ্ধঃ ঘটিকাদ্বয়মিষ্যতে’ । অথাৎ, সূর্য্য অস্ত গেলে পর দুই মুহূর্ত্তের নাম প্রদোষ।
৩০ আশ্বিন সূর্য্যাস্তের পর দুই মুহূর্ত্ত অর্থাৎ ১ ঘন্টা ৩৬ মিনিট পর্যন্ত পূর্ণিমা থাকছে না, কিন্তু আগের দিন ২৯ আশ্বিন নিশীথে পূর্ণিমা থাকছে ; বিধায় উক্ত আচার্য্যগণের সিদ্ধান্ত অনুসারে-২৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ( ১৬ অক্টোবর ২০২৪ ইং ) তারিখে কোজাগরী পুজোর উৎসব পালিত হবে। এদিন পুজোর নিশীথ কাল মুহূর্ত রাত ১১টা ৪২ মিনিট থেকে ১২টা ৩২ মিনিট পর্যন্ত, আর এই দিনে চন্দ্রোদয় হয়েছে বিকেল ৫টা ৫ মিনিটের কাছাকাছি। গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা মতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন পূর্ণিমা তিথি পড়ছে ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭ টা ৪২ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে। আর ১৭ অক্টোবর পূর্ণিমা তিথি শেষ হচ্ছে, বিকেল ৫ টা ১৭ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে । চলতি বছর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর এটাই তিথি । আবার বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকামতে বুধবার রাত ৮ টা ৪১ মিনিটে পূর্ণিমা তিথি পড়ছে, আর বৃহস্পতিবার বিকেল ৪ টে ৫৬ মিনিটে শেষ হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে প্রদোষ থেকে নিশীথ অবধি তিথি থাকলেও সেই প্রদোষেই পুজা বিহিত | কিন্তু পূর্বদিনের রাত্রি থেকে পরদিন প্রদোষ পর্যন্ত তিথি থাকলে পরদিন প্রদোষেই পুজো করা বিধেয় | আবার পূর্বদিন রাত্রে তিথি (পূর্ণিমা/অমাবস্যা) থাকলেও যদি পরদিন প্রদোষে তিথি না থাকে তাহলে পূর্বদিন প্রদোষেই পুজো করা কর্তব্য ।
কিভাবে হয় এই কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা? আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অর্থাৎ কোজাগরী পূর্ণিমায় দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলার ব্রত’ বইতে এই লক্ষ্মীপূজা সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি জানান, দেবীর কাছে ভালো ফলনের কামনা করাই আসলে এই পূজার নৃতাত্ত্বিক কারণ। পূজা বা ব্রত কথার সঙ্গে আলপনার একটি সম্পর্ক রয়েছে। আলপনা আসলে ‘কামনার প্রতিচ্ছবি।’ দেবী পূজা উপাচার হিসেবে থাকে ফল, মিষ্টি, মোয়া, নাড়ু প্রভৃতি। কোজাগরী লক্ষ্মীর প্রতি আচার নিবেদনের সঙ্গেও একটি লোকবিশ্বাস জড়িত রয়েছে। পূজার সময় মোট ১৪টি পাত্রে উপাচার রাখা হয়। তারপর পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে জল দানের রীতি রয়েছে। কাঠের জলচৌকির ওপর লক্ষ্মীর সরাটিকে স্থাপন করা হয়। এরপর কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণ মুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকি দিয়ে সাজানো হয় পূজার স্থানটিকে।লক্ষ্মীপুজোয় যে আল্পনা দেওয়া হয়, তাতে মায়ের পায়ের ছাপও আঁকা হয়। বিশ্বাস ওই পথেই মা ঢুকবেন গৃহস্থের ঘরে। লক্ষ্মী চঞ্চলা। তবে ক্রোধী দেবী নন। তাই যেকোনও গৃহস্থই লক্ষ্মীর ঝাঁপি করে লক্ষ্মীর পিঁড়ি পাতেন গৃহকোণে। স্থানাভাবে একটি মাত্র ঘরের কুলুঙ্গিতে। উপাচার তো সামান্যই। প্রতি বৃহস্পতিবারে (লক্ষ্মীবার শব্দটি ব্যবহৃত) সামান্য ফুল-বাতাসা আর ধোয়া পিঁড়িতে চাল পিটুলির আলপনা। সেটাই একটু বড় আকারের এই কোজাগরীর রাতে।
শাস্ত্র মতে বলা হয়, মা লক্ষ্মী খুব অল্পেতেই সন্তুষ্ট হয়, তবে তার পুজোর জন্য কিছু বিশেষ নিয়মও কিছু বিধিনিষেধ মানতে । শারদ পূর্ণিমার দিনে পায়েসের মাহাত্ম্য রয়েছে, শারদ পূর্ণিমার দিনে বাড়িতে বানানো পায়েস চাঁদের আলোয় রাখলে ও পরে তা খেলে তা খুবই শুভ ফল দেয়। চাঁদের আলোয় রাখা পায়েস খেলে বহু কষ্ট থেকে মুক্তি হয়, ও সুখ সমৃদ্ধি বাড়ে। তবে মা লক্ষ্মীর পুজোর সময় কোনওভাবেই তুলসী পাতা দেবেন না৷ এতে মা লক্ষ্মী রুষ্ট হন৷ লক্ষ্মীপুজোর দিন কখনওই লোহার বাসন ব্যবহার করবেন না৷ এদিন বাড়ি থেকে অন্য কাউকে চাল দেবে না৷ মা লক্ষ্মীকে পুজোর সময় সাদা রঙের ফুল নিবেদন করবেন না৷ লাল, হলুদ, গোলাপি রঙের ফুল অর্পন করুন এবং দেবীর আসনে সাদা বা কালো কাপড় ভুলেও পাতবেন না৷লক্ষ্মীপুজোর দিন ভুলেও কাঁসর ঘণ্টা বাজাবেন না৷ এতে মা লক্ষ্মী রুষ্ট হন৷ পুজোর সময় কালো বা সাদারঙের পোশাক না পরাই ভাল৷ লক্ষ্মীপুজোর দিন মা লক্ষ্মীর যে কোনও কাজের জন্য কলাপাতা ব্যবহার করুন৷
শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র :
“নমামি সর্বভূতানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে
যা গতিস্ত্বৎপ্রপন্নানাং সা মে ভূয়াৎ ত্বদর্চনাৎ ।”
অর্থাৎ ‘হে হরিপ্রিয়ে,তুমি সকল প্রাণীকে বরদান করিয়া থাক, তোমাকে প্রণাম করি | যাহারা তোমার শরণাগত হয়, তাহাদের যে গতি, তোমার পূজার ফলে আমারও যেন সেই গতি হয় ।’
শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর ধ্যান মন্ত্র :
ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ সৃণিভির্যাম্য সৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনাস্থাং ধায়েচ্চ শ্রীয়ং ত্রৈলোক্য মাতরং।।
গৌরবর্ণাং স্বরূপাঞ্চ সর্বালঙ্কারভূষি তাম্।
রৌক্নোপদ্মব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।
শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর স্তোত্রম্ :
ত্রৈলোক্য পূজিতে দেবী কমলে বিষ্ণুবল্লভে।
যথাস্তং সুস্থিরা কৃষ্ণে তথা ভবময়ি স্থিরা।।
ঈশ্বরী কমলা লক্ষ্মীশ্চলা ভূতি হরিপ্রিয়া।
পদ্মা পদ্মালয়া সম্পদ সৃষ্টি শ্রীপদ্মধারিণী।।
দ্বাদশৈতানি নামানি লক্ষ্মীং সম্পূজ্য যঃ পঠেত।
স্থিরা লক্ষ্মীর্ভবেৎ তস্য পুত্রদারারদিভিংসহ।।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:- অবশ্যই তিন বার পাঠ করতে হবে
শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর প্রণাম মন্ত্র :
ওঁ বিশ্বরুপস্য ভার্য্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।
সর্ব্বতঃ পাহি মাং দেবি মহালক্ষ্মী নমোহস্ত্ত তে।
লক্ষ্মী স্তং সর্ব্বভুতানাং যথা বসতি নিত্যশঃ।
স্থিরা ভব সদা দেবি মম জন্মনি জন্মনি।
দেবী লক্ষ্মীর মন্ত্র : শ্রীং লক্ষী দেবৈই নমঃ (২৮ বার)
লাং ইন্দ্রায় নমঃ (১৮ বার)
ইং কুবেরায় নমঃ (১০ বার)
ঔঁ নমঃ নারায়ণায় শ্রীবীষ্ণবে নমঃ (১ বার)
মা লক্ষীর ১০৮ নাম করলে সেখানে কোনদিন অর্থাভাব থাকে না :-
১) প্রকৃতি ,২) বিক্রুতি , ৩) বিদ্যা , ৪) সর্বভূতহিতপ্রদা, ৫) শ্রদ্ধা , ৬) বিভূতি, ৭) সুরভি, ৮) পরমাত্মিকা , ৯) জয়প্রদা , ১০) পদ্মালয়া , ১১) পদ্মা , ১২) শুচী, ১৩) স্বাহা, ১৪) স্বাধা, ১৫) সুধা , ১৬) ধন্যা , ১৭) হিরন্ময়ী, ১৮) লক্ষ্মী , ১৯) নিত্যাপুষ্টা, ২০) বিভা, ২১) অদিত্যা, ২২) দিত্যা, ২৩) দীপা, ২৪) বসুধা, ২৫) ক্ষীরোদা, ২৬) কমলাসম্ভবা, ২৭) কান্তা, ২৮) কামাক্ষী, ২৯) ক্ষীরোদসম্ভবা , ৩০) অনুগ্রহাপ্রদা, ৩১) ঐশ্বর্য্যা , ৩২) অনঘা, ৩৩) হরিবল্লভী, ৩৪) অশোকা , ৩৫) অমৃতা, ৩৬) দীপ্তা, ৩৭) লোকাশোকবিনাশিনী, ৩৮) ধর্মনিলয়া, ৩৯) করুণা, ৪০) লোকমাতা, ৪১) পদ্মপ্রিয়া, ৪২) পদ্মহস্তা, ৪৩) পদ্মাক্ষী , ৪৪) পদ্মসুন্দরী, ৪৫) পদ্মভবা, ৪৬) পদ্মমুখী, ৪৭) পদ্মনাভপ্রিয়া, ৪৮) রমা, ৪৯) পদ্মমালাধরা , ৫০) দেবী,৫১) পদ্মিনী, ৫২) পদ্মগন্ধিণী , ৫৩) পুণ্যগন্ধা, ৫৪) সুপ্রসন্না, ৫৫) শশীমুখী , ৫৬) প্রভা, ৫৭) চন্দ্রবদনা, ৫৮) চন্দ্রা , ৫৯) চন্দ্রাসহোদরী , ৬০) চতুর্ভুজা , ৬১) চন্দ্ররূপা , ৬২) ইন্দিরা, ৬৩) ইন্দুশীতলা, ৬৪) আহ্লাদিণী, ৬৫) নারায়নী , ৬৬) বৈকুন্ঠেশ্বরি ৬৭) হরিদ্রা ৬৮) সত্যা , ৬৯) বিমলা, ৭০) বিশ্বজননী, ৭১) তুষ্টি, ৭২) দারিদ্রনাশিণী, ৭৩) ধনদা , ৭৪) শান্তা, ৭৫) শুক্লামাল্যাম্বরা , ৭৬) শ্রী, ৭৭) ভাস্করী , ৭৮) বিল্বনিলয়া , ৭৯) হরিপ্রিয়া , ৮০) যশস্বীনি , ৮১) বসুন্ধরা , ৮২) উদারঙ্গা, ৮৩) হরিণী , ৮৪) মালিনী, ৮৫) গজগামিনী , ৮৬) সিদ্ধি , ৮৭) স্ত্রৈন্যাসৌম্যা , ৮৮) শুভপ্রদা, ৮৯) বিষ্ণুপ্রিয়া , ৯০) বরদা , ৯১) বসুপ্রদা, ৯২) শুভা , ৯৩)চঞ্চলা , ৯৪) সমুদ্রতনয়া , ৯৫) জয়া , ৯৬) মঙ্গলাদেবী, ৯৭) বিষ্ণুবক্ষাস্থলাসিক্তা , ৯৮) বিষ্ণুপত্নী, ৯৯) প্রসন্নাক্ষী , ১০০) নারায়নসমাশ্রিতা ,(১০১) দারিদ্রধ্বংসিণী, ১০২) কমলা, ১০৩) সর্বপ্রদায়িনী, ১০৪) পেঁচকবাহিণী, ১০৫) মহালক্ষ্মী, ১০৬) ব্রহ্মাবিষ্ণুশিবাত্মিকা , ১০৭) ত্রিকালজ্ঞানসম্পূর্ণা, ১০৮) ভুবনমোহিনী।।