প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৮ অক্টোবর : পুজোর সময়েও চোখের কোনে জল নিয়ে বাড়ির দুয়ারে বসে আছো কেন গো? উত্তরে অসহায় মানুষ গুলো চোখের জল মুছে বললেন,’জানেন বাবু,দুর্গা মা আসছেন বলে আমাদের মনেও আনন্দ জেগেছিল।কিন্তু মায়ের আগমনের আগে প্রকৃতি যে আমাদের মত গরিব মানুষ গুলোকে এমন চরম দুর্দশায় ফেলবে তা কল্পনাও করতে পারিনি ।’ এক টানা ভারী বৃষ্টিপাত চলার মধ্যেই দামোদর ভয়ংকর প্রলয় রুপি বন্যা ঘটিয়ে দিল।সেই বন্যার জল তছনছ করে দেয় আমাদের মত গরিব মানুষের একমাত্র সম্বল ছিটে বেড়া আর মাটির দেওয়ালের ঘরবাড়ি গুলো।প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিতে হয় বাঁধে।জল কমার পর ধার দেনা করে বাসস্থানকে বাসযোগ্য করে তুলতে নেমে এখন আমাদের কালঘাম ছুটছে।দুঃখের কথা কি আর বলি বাবু,’দুর্গা মায়ের পুজোয় আনন্দ করার সৌভাগ্য আমাদের মত গরিব মানুষদের কপালেই নেই!’
এইসব কথা গুলো নিছক গল্পকথা বলে অনেকেরই মনে হতে পারে। কিন্তু না,দেবীপক্ষে এটাই পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের শিয়ালী ও কোরা গ্রামের বাসিন্দাদের জীবন দুর্দশার বাস্তব কাহিনী। মহা পঞ্চমীর দিন চোখের জল মুছতে মুছতে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে তাঁরা তাঁদের জীবন দুর্দশার এমন করুণ কাহিনীর কথাই ব্যক্ত করলেন। সাথে এও জানালেন,’সরকারী আবাস যোজনার একটা পাকা বাড়ি পাওয়ার সৌভাগ্য লাভের আর্তিই তাঁরা এখন দেবী দুর্গা মায়ের কাছে রেখে চলেছেন।
কথায় আছে ,’নদীর পাড়ে বাস দুঃখ বারো মাস’। হ্যাঁ, ঠিক এই কথাটাই এখন প্রতিমুহূর্তে ভাবাচ্ছে জামালপুর ব্লকের জ্যোৎশ্রীরাম অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রাম শিয়ালী ও কোরার বাসিন্দাদের।কারণ তাঁদের গ্রামের কাছ দিয়েই বয়ে গিয়েছে দামোদর। কোন বছর বৃষ্টিপাত একটু বেশী হওয়ার পর ডিভিসি জল ছাড়লেই তাঁদের বিপদ বাড়ে ।নিম্ন দামোদর এলাকায় বন্যা আর নদী পাড়ের ভাঙন অবধারিত হয়ে পড়ে ।বন্যয় শুধু ঘর বাড়ি জলের তলায় চলে যায় না,চাষের জমিরও সলিলসমাধি ঘটে। শিয়ালী ও কোরা গ্রামের ভবিতব্য সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোরা গ্রামের বৃদ্ধা মেনকা বাউরি মঙ্গলবার বলেন, ’বন্যা আর ভাঙন,এই দুইকে ভবিতব্য মেনে নিয়েই আমাদের জীবন কাটে ।আমরা গরিব মানুষ গো বাবু। দিন আনি দিন খাই। ছিটেবেড়ায় মাটির প্রলেপ দেওয়া ঘরই আমাদের সম্বল।এবারের বন্যা আমাদের সেই বাসস্থানটাই তচনছ করে দিয়েছে।বাঁশের ঠেকনায় ঘরটা কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের আসে পাশে হরদম সাপ ঘোরা ফেরা করছে। তবুও কোন উপায় না থাকায় ওই ঘরেই এখন আমাদের বসবাস করতে হচ্ছে।দুর্গা মা আমাদের দিকে মুখ ফিরে চাইলে তবেই হয়তো আমাদের সরকারী পাকা বাড়ি পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ হবে।’
বন্যা পরবর্তীতে জীবন দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে চোখের জল ধরেরাখতে পারলেন না কোরা গ্রামের দরিদ্র পরিবারের তিন বধূ মামনি বাউরি,কল্পনা বাউরি ও ফুলেশ্বরী বাউরি ।তাঁরা বলেন,’দেবীপক্ষ তখনও পড়ে নি।কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টিপাত হয়ে যাচ্ছিল।ওইসময় গ্রামের মানুষের কাছে খবর পাই ডিভিসি নাকি প্রচুর জল ছেড়েছে।তারপর রাত পেরুতে না পেরুতে আমরা দেখি দামোদর জলে টইটুম্বুর হয়ে গিয়েছে।প্রচণ্ড শ্রোতে জল বই য়ে যাচ্ছিল।এর খানিক পরেই দামোদর ছাপিয়ে জল আমাদের গ্রামে হু হু করে ঢুকতে শুরু করে ।মুহুর্তের মধ্যে আমাদের ঘর বাড়ি ও এলাকার চাষ জমি সব জলে ঢুবে যায় ।জীবন বাঁচাতে শিশু সন্তান সহ পরিবারের সবাই নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে বাঁধে গিয়ে উঠি। ত্রিপল খাটিয়ে দু’তিন দিন বাঁধেই কাটাতে হয় ।’ বন্যার বিভৎসতার একই রকম অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন শিয়ালী গ্রামের বিকাশ রায়,বাপি রায়,কনকলতা রায়, চাঁপা রায় ও মিঠু রায়’রা ।
দুই গ্রামের বন্যা দুর্গত এইসব মানুষজন জানান, নদীর জল কমে যাওয়ার পর বাঁধথেকে নেমে তাঁরা গ্রামে ফেরেন । গ্রামে ফিরে দেখেন বন্যার জল তাঁদের ঘর বাড়ি গুলো সব শেষ করে দিয়েছে। কোনরকমে বাড়িটা অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।আর খেতের সব ফসল জলে পচে নষ্ট হয়ে গেছে। মাঠে খেত মজুরি বা দিন মজুরির কাজ না করলে তাঁদের পেটের ভাত জোগাড় হয় না। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়া বাড়ি বাসযোগ্য করে তোলার অর্থ কিভাবে জোগাড় হবে সেই দুশ্চিন্তাই এখন তাঁদের কুরে কুরে খাচ্ছে বলে শিয়ালী ও কোরা গ্রামের অসহায় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।
পুজোর মুখে হওয়া বন্যায় গ্রাম,জমি ও নিজের বাসস্থানটা জল প্লাবিত হয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পুজোর আনন্দটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে কোরা গ্রামের বাবলু বাউরির।তাঁকে এদিন দেখা গেল খড় কুচো দিয়ে মাটি মেখে ছিঁটেবেড়ার দেওয়ালে ধরাতে ।বাড়ির এমন দুরাবস্থা কি করে হল? এই কথা জিজ্ঞাসা করতেই এক বুক হতাশা নিয়ে বাবলু বলেন,’বন্যা আমার বাড়িটাকে শেষ করে দিয়েছে। ঘরটা না বাগালে ছেলেপুলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকবো কোথায় । তাই নিজেই খেটে বাড়িটা বাসযোগ্য করছেন বলে বাবলু জানান। পুজোয় বাড়ির বউ বাচ্চাদের নতুন জামা কাপড় কেনা কাটা হয়ে গেছে?এই প্রশ্ন শুনে বাবলু প্রথমে একটু চটে যান।পরে ভারাক্রান্ত মনে তিনি বলেন, ’পুজোয় আনন্দ করার ভাগ্য নিয়ে আমারা জন্মইনি বাবু । খেতে খামারে কাজ করে সামান্য যে টুকু রোজগার হয় তা দিয়েই আমার সংসার চলে।তবে এবছরেষ পুজোয় বউ বচ্চাকে নতুন জামা কাপড় কিনে দেওয়ার জন্য সারা বছর ধরে কিছু কিছু করে অর্থ জমিয়ে ছিলাম।কিন্তু সেই অর্থ এখন ঘর বাগাতেই চলে যাচ্ছে।নতুন জামা-কাপড় কিনে দেওয়ার সাধ্য আর এখন আমার নেই’। বাবলু বাউরি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন,’এ বছর পুজোয় ’সর্বহারার’ মতন’ই আমাদের দিন কাটবে’ ।
বাবলু বাউরির সাথে সাথে বিকাশ রায়,বাপি রায় ও তাদের পরিবার সদস্যরাও মনে করেন,’সরকারি ক্ষতিপূরণ তাড়াতাড়ি না পেলে তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। সরকারী আবাস যোজনার পাকা বাড়ি লাভের সৌভাগ্য যেন তাঁদের হয় ,সেই প্রার্থনাই তাঁরা দেবী দুর্গা মায়ের কাছে করছেন’।এ ব্যাপারে জেলাশাসকের কথায় একটু হলেও আশার আলো দেখছেন শিয়ালী ও কোরা গ্রামের এইসব বাসিন্দারা। দিন দুই আগে শিয়ালী ও কোরা গ্রাম পৌছে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর বাড়ির অবস্থা নিজে দেখে যান জেলাশাসক আয়েষা রাণী এ। ওই দিন জেলাশাসক জানিয়ে যান,যাঁদের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁদের নাম ’বাংলা আবাস যোজনার’ তালকায় তুলে দেওয়ার জন্য তিনি জামালপুর ব্লকের বিডিওকে নির্দেশ দিয়েছেন ।।