পরাগ জ্যোতি ঘোষ,মঙ্গলকোট(পূর্ব বর্ধমান),১৪ সেপ্টেম্বর : সময়টা তখন দুপুর তিনটের আশপাশ । পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটের সিউর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যেতেই কানে ভেসে এল কচিকাঁচাদের সমবেত সঙ্গীত ‘আমরা সবাই রাজা আমাদেরই এই রাজার রাজত্বে’…কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরপরিচিত সেই গানের কলি । স্কুলের একটা শ্রেণী কক্ষের দরজায় উঁকি দিতেই দেখা গেল হাতে একটা ডুগি নিয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গত দিতে দিতে তাদের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ব্রজলাল মজুমদার । ব্যাপারটা কি ? স্কুলের এক সহ শিক্ষকের কাছে বিষয়টা নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এটাই স্যারের পড়ানোর টেকনিক । ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠনে আরও মনোযোগী করে তুলতে স্কুলের টিফিনের পর রোজ তিনি এভাবেই গান শেখান ।’ তাতে একদিকে যেমন পড়ুয়াদের পড়াশোনার মান উন্নত হয়, অন্যদিকে তেমনি সঙ্গীত চর্চাও হয় তাদের,বলে মন্তব্য করেছেন তিনি ।
জানা যায়,পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ায় আদি বাড়ি ব্রজলাল মজুমদারের । কয়েক দশক ধরে তিনি মঙ্গলকোট থানার সিউর প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছে । শিক্ষকতার সুবিধার জন্য তিনি সিউরের পার্শ্ববর্তী সারঙ্গপুর গ্রামে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন । বাড়িতে রয়েছেন স্ত্রী । এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে । কর্মজীবনের আগে থেকেই গানবাজনার প্রতি আকর্ষণ ছিল ব্রজলালবাবুর । একমাত্র মেয়ের গানবাজনার হাতেখড়ি বাবার কাছেই । বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে গুসকরা মহাবিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে শিক্ষকতা করছেন ব্রজলালবাবুর মেয়ে ।
মঙ্গলকোট-১ নম্বর চক্র বিদ্যালয়ের পরিদর্শক শ্যামল ঘোষ বলেন,’ব্রজবাবু একজন আদর্শ শিক্ষক । সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল তিনি সংস্কৃতি মনস্ক । আর তার এই বিশেষ গুণের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন শিক্ষকতা পেশাতেও । পঠনপাঠনের সঙ্গে সঙ্গীতের অভিনব প্রয়োগ ঘটিয়ে পড়ুয়াদের একদিকে যেমন সংস্কৃতি মনস্ক করে তুলছেন, তেমনি পড়ুয়াদের মেধার বিকাশেও সাহায্য করছে । ব্রজলালবাবুর এই অভিনব প্রচেষ্টা প্রশংসার যোগ্য ।’
জানা গেছে,সিউর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৪৫ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে । ব্রজলাল মজুমদার প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অনান্য বিষয়ের পাশাপাশি গানের ক্লাসকে তিনি কার্যত বাধ্যতামূলক করেন । প্রতিদিন স্কুলের টিফিনের পর বিকেল তিনটে থেকে স্কুলে গানের ক্লাস হয় । এছাড়া শনিবার স্পেশাল ক্লাস নেওয়া হয় । গানের শিক্ষক খোদ তিনিই । কচিকাঁচাদের মধ্যেও গানের ক্লাস ঘিরে থাকে ব্যাপক উৎসাহ ।
কিন্তু পঠনপাঠনের ও সঙ্গীতের সংমিশ্রণের বিষয়টি কেন মাথায় এল ? এই প্রশ্নের উত্তরে সলজ্জ ব্রজলালবাবু বলেন,’এই,পড়ুয়াদের সঙ্গে একটু আনন্দ করি আর কি । এছাড়া ওদের সঙ্গীতের চর্চাও হয় । অনেক পড়ুয়া গানের ক্লাস করার জন্য মুখিয়ে থাকে । এটা দেখে খুব ভালো লাগে ৷’ গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, ব্রজলাল মজুমদার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার পর স্কুলছুটের সংখ্যা নেই বললেই চলে । তবে শুধু গানই নয়,পড়ুয়াদের পঠনপাঠন থেকে শুরু করে স্কুল পরিচালনার দিকে তার সর্বদা সজাগ দৃষ্টি থাকে । বিদ্যালয়ের পরিদর্শক শ্যামল ঘোষ জানিয়েছেন,স্কুলের হিসাব নিকাশে কোন গাফলতি নেই তাঁর । খুব সুন্দরভাবেই সেরে রেখে দেন অর্থনৈতিক লেনদেনের হিসাব । মিড ডে মিলও খুব ভালোভাবেই চলছে স্কুলে । তিনি এও জানান যে সহকারী দুই শিক্ষকও যথেষ্ট ছাত্রদরদী।
কিন্তু মাত্র তিন মাস পরেই স্কুলকে চিরতরে বিদায় জানাতে চলেছেন ব্রজলাল মজুমদার৷ আর একথা ভেবেই এখন থেকে মন খারাপ পড়ুয়া ও অবিভাবকদের । স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী শিল্পি,পূজারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘প্রধান শিক্ষক স্যার চলে গেলে স্কুলটা একদম ফাঁকা হয়ে যাবে । তারপর আমাদের কে গান শেখাবেন ?’