‘আইডিয়া অফ পাকিস্তান’ কার মস্তিষ্ক প্রসূত ? হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী নাকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ? কিন্তু বাস্তবে এদের দুজনের কারোর মাথাতেই প্রথমে এই ‘আইডিয়া’ আসেনি । যার মাথায় এসেছিল,তিনি আর কেউ নন, ভারতের কথিত সেকুলাররা যার নাম বলতে অজ্ঞান, সেই ‘সারে জাহান সে আচ্ছা’ গানের স্রষ্টা মহম্মদ ইকবাল । একজন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ যার পূর্বপুরুষরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইকবালের দাদু সহজ সাপ্রুর কথা মনে আছে ? একজন হিন্দু কাশ্মীরি পণ্ডিত, প্রথম দিকে সবকিছু ঠিক ছিল। পরবর্তীকালে, তিনি দ্বিজাতি তত্ত্ব অর্থাৎ ভারত ভাঙতে গুরুতরভাবে নিযুক্ত হন! কারণ তার মনে গেঁথে যায়… আরে ভাই, আমি তো একজন মুসলিম।
যাই হোক,এক অর্থে ইকবাল মাসুদিই পাকিস্তানের জনক । কারণ তিনি ভারতীয় মুসলিম লীগের ২১ তম অধিবেশনে তার সভাপতির ভাষণে “পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তান নিয়ে গঠিত একটি রাজ্য গঠনের জন্য প্রথম প্রস্তাব তোলেন”। ১৯৩০ সালের ২৯শে ডিসেম্বর এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত আলোচনার কথা উল্লেখ করেন। ইকবালই সর্বপ্রথম ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ধারণা উত্থাপন করেন। ১৯৩০ সালে, তার নেতৃত্বে, মুসলিম লীগ সর্বপ্রথম ভারত ভাগের দাবি উত্থাপন করে, এর পরে তিনি জিন্নাহকেও মুসলিম লীগে যোগদানের জন্য অনুপ্রাণিত করেন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য তার সাথে কাজ করতে ইকবাল তাকে আহ্বান জানান। ভারত বিভাজনের কথা বলেছিল, যা ভারতকে হুমকির মুখে ফেলেছিল এবং যার মতাদর্শে ধর্মান্ধতা এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে দেশে আগুন জ্বলেছিল । পাকিস্তানে তাকে সম্মান করাটা বোধগম্য হলেও ভারতে মৌলবাদের এই জনককে পূজা করা আশ্চর্যজনক ।
ইকবাল ১৯০৪ সালে ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধের সময় লিখেছিলেন ‘সারে জাহান সে আচ্ছা’। এটি মূলত শিশুদের জন্য লেখা, যা সারা দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সময়ের সাথে সাথে শুধু ইকবাল বদলায়নি, পাল্টেছে তার সুরও। মোহাম্মদ ইকবাল তখন সরকারি কলেজ লাহোরের প্রভাষক ছিলেন। তাঁর এক ছাত্র, লালা হরদয়াল তাঁকে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন যেখানে তিনি ‘সারে জাহান সে আচ্ছা’ গান গেয়েছিলেন। বক্তৃতা না করে তিনি তার এই গানটি গেয়েছিলেন এবং সভায় উপস্থিত লোকজন এর অনেক প্রশংসা করেন। লালা হরদয়াল পরে গদর পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং সিভিল সার্ভিসে ব্যর্থ হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
আজ, ভারতে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ রয়েছে যারা ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ এবং মুহম্মদ ইকবালের পূজায় নিয়োজিত এবং তাদের দেখাদেখি অন্যরাও তাই করে । কিন্তু কেমন মানসিকতার ছিলেন মুহম্মদ ইকবাল ? তার মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে তার রচিত কবিতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে । কয়েকটি কবিতার একাংশ এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হল,যেখানে মুহম্মদ ইকবালের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে ।
ইউরোপ থেকে ফিরে আসা মুহাম্মদ ইকবালের ‘তারানা-ই-মিলি’-এর প্রথম লাইনগুলো দেখুন, যেটা বলে যে ভারতের প্রতি তার কোনো সম্মান ছিল না এবং তার দৃষ্টিতে ইসলামই ছিল একমাত্র শক্তি । ইকবালের হিন্দু ও দেশবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ওই কবিতায় প্রকাশ পায় :- “ইন তাজা খুদাও মে,বড়া সবসে বতন হ্যায়/যো প্যারহন(পরিধান) উসকা হ্যায়, বো মজহব কা কফন হ্যায় /বাজু তেরা দেশ তু মুস্তফবী হ্যায় /নজ্জারা-এ-দেরিনা জমা এ কো দিখা দে” । অর্থাৎ,একত্ববাদের শক্তির কারণে তোমার হাত প্রবল। ইসলাম তোমাদের দেশ কারণ তোমরা মুস্তাফার (মুহাম্মদের অপর নাম) এই পুরানো অভিজ্ঞ দর্শনকে দেখাও, এই মূর্তি (জাতিকে) মাটিতে ফেলে দাও।
এখন ইকবালের আরও একটা কবিতা পড়ুন :-
চীন-ও-আরব হমারা হিন্দুস্তাঁ হমারা
মুসলিম হ্যায় হম বতন হ্যায় সারা জহাঁ
তৌহিদ কি অমানত সীনো মে হ্যায় হমারা
আসাঁ নহো মিটানা নাম-আও-নিশাঁ হমারা
দুনিয়া কে বুত-কদো মে পহলা বো ঘর ঘুদা কা
হম ইস কে পাসবাঁ হ্যায় বো পাসবাঁ হমারা
তেংগো সাএ মে হম পল কর জবাঁ হুয়ে হ্যায়
খঞ্জর হিলাল কা হ্যায় কউমো নিশাঁ হমারা
মগরিব কী বাদিও মে গুঁজী অজাঁ হমারী
থমতা ন থা কিসী সেল-এ-রবাঁ হমারা
বাতিল সে দবনে বালে এ আসমাঁ নহী হম
সও বার কর চুকা হ্যায় ইম্তিহাঁ হমারা
অ্যায় গুলিস্তান-এ-উদুলুস বো দিন হ্যায় ইয়াদ তুঝ কো
থা তেরী ডালিয়াঁ মে জিব আশিয়াঁ হমারা
এয় মৌজ-এ-দজলা তু ভী পহচানতী হ্যায় হম কো
অব তক হ্যায় দরিয়া আফসানা-রখাঁ হমারা
এয় অর্জ-এ-পাক তেরী পে কট মরে হম
হ্যায় খুঁ তেরি রংগো মে অব তক রবাঁ হমারা
সালার-এ-কারবাঁ হ্যায় মীর-এ-হিজাজ অপনা
ইস নাম সে হ্যায় বাকী আরাম-এ-জাঁ হমারা
‘ইকবাল’ কা তরানা বাঁগ-এ-দরা হ্যায় গোয়া
হোতা হ্যায় জাদা-পেয়মা ফির কারবাঁ হমারা
সূত্র: কল্যাণ ইকবাল গ্রন্থের (পৃষ্ঠা ১৫৯ ), লেখক: আল্লামা ইকবাল, প্রকাশনা: এডুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি (২০১৪) । এই লাইনগুলোতে ইকবাল স্পষ্টভাবে ভারতীয় দেশপ্রেমকে গৌণ বলে বর্ণনা করছেন এবং সমগ্র বিশ্বকে মুসলমানদের দেশ বলছেন। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘ওয়াতানিয়াত’-এ তিনি ইসলামের প্রবর্তক মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সাথে যুক্ত করে দেশ বিভাগের ফলে সৃষ্ট হিজরতকে মহিমান্বিত করেছেন।
‘অ্যায় তর্কে বতন সুন্নতে মহবুবে ইলাহী / দে তু ভী নবুবত কী সদাকত পে ।’ অর্থাৎ, নিজ দেশ ত্যাগ করা আল্লাহর প্রিয় (মুহাম্মাদ) এর আচার-আচরণ, তোমরাও এই নবুওয়াতের সত্যতার সাক্ষ্য দাও, অর্থাৎ তাঁর মতো তোমাদের দেশ ত্যাগ করতে প্রস্তুত হও।
ইকবালের গণতন্ত্রবিরোধী ধারণা:
‘জম্হুরিয়ত হক তর্জ-এহুকুমত হ্যায় কি জিসমে / বন্দো কো গিনা করতে হ্যায় তৌলা নহী করতে ।’
গণতন্ত্রে প্রতিটি মানুষের ভোট তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে সমান। এতে ইকবাল খুব কষ্ট পেয়েছিলেন এবং তিনি গণতন্ত্রের এই রূপকে নিয়ে মজা করে বলেন যে, এ কেমন ব্যবস্থা যে এতে মানুষের মর্যাদা অবহেলিত হচ্ছে।
ইকবালের ছেলে জাভেদ ইকবাল, যিনি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক ছিলেন, তার বাবার জীবনী ‘জিন্দা রুড’-এর ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে তার বাবা কাশ্মীরি ব্রাহ্মণদের একটি প্রাচীন পরিবারের সদস্য ছিলেন, যার গোত্র হল সাপ্রু।
নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে প্রশংসা করতে গিয়ে ইকবাল লিখেছেন: ম্যায় অসল কা খাস সোমনাতী /আব্বা মেরে লাতী ও মনাতী/তু সৈয়দ-হাশিমী অউলাদ/ মেরে কফ-এ-খাক ব্রাহ্মনজাত’….ইকবাল এই কবিতাটি লিখেছিলেন এক সাইয়্যেদের ছেলেকে দিয়ে। এই লাইনগুলিতে, ইকবাল গর্বভরে তার পূর্বপুরুষদের বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে আমি তাদের বংশধরদের মধ্যে একজন যারা সোমনাথের পাশাপাশি আরবি দেবতা লা ও মন-এর উপাসক ছিলাম। আপনি যদি হাশমী সাইয়্যেদের বংশধর হন, তবে আমিও কম নই, আমিও একজন ব্রাহ্মণের সন্তান।
মেরা বিনি কি দার হিন্দুস্তান দিগার নামি বিনি/ বারহমান জাদায়ে রামজ আশনা-ই-রুম এবং তাবরেজ আস্ত( ভারতে আপনি আমার মতো কাউকে দেখতে পাবেন না । আমি ব্রাহ্মণপুত্র মাওলানা রুমি ও শামস তাবরিজের রহস্যের সাথে পরিচিত) ।
য়ু তো সৈয়দ ভী মির্জা ভী হো অফগান ভী হো / তুম সভী কুছ হো,বতাও মুসলমান ভি হো’….এখানে ইকবাল শুধু আশরাফ জাতি উল্লেখ করেছেন এবং তাদের মধ্যে ঐক্যের কথা বলেছেন। মনে হয় সৈয়দের মতো তিনিও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলমানদেরকে মুসলমান মনে করেননি, নইলে দু-একটি ভারতীয় বর্ণ উল্লেখ করতে সমস্যা কী ছিল। স্যার সৈয়দ কে ছিলেন? ব্রিটিশরা তার প্রতি এতটাই সদয় ছিল যে তারা তাকে কেরানি থেকে মইনপুরীর সাব-জজ পদে উন্নীত করে। ভাইয়েরা, সৈয়দ আহমদ সাহেব মুসলমানদেরকে হিন্দুদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন, শুধু তাই নয়, হিন্দি ভাষাকে বলতেন অশিক্ষিতদের ভাষা। তাঁর মতামতও ছিল মুসলমানদের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতি ও মহিলাদের বিরুদ্ধে।
আসলে এই আশরাফ মুসলমান কারা? এখানে বিদেশী এবং দেশীয়দের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আশরাফ, আজলাফ ও আরজালের শ্রেণীবিভাগ ইসলামী ফিকহ (আইন) এবং ইসলামী ইতিহাসের বইতেও পাওয়া যায়। আশরাফ যা শরীফ (উচ্চ) শব্দের বহুবচন যার একটি বহুবচন রূপও রয়েছে শোরফা যার মধ্যে আরব, ইরানী, তুর্কি, সৈয়দ, শেখ, মুঘল, মির্জা, পাঠান প্রভৃতি বাইরে থেকে আসা জাতি অন্তর্ভুক্ত যারা শাসক ছিল । আজও তারা ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানসহ ইসলামি দেশগুলোতে ক্ষমতায় রয়েছে। জিলফ (অসভ্য) এর বহুবচন হল আজলাফ, যার মধ্যে বেশিরভাগ কারিগর জাতি রয়েছে যারা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
আরজাল হল রাজীল (নিচু) এর বহুবচন যা বেশিরভাগ স্যানিটেশন কাজে নিযুক্ত জাতি নিয়ে গঠিত এবং যা হিন্দু দলিত বর্ণের সমতুল্য। আজলাফ এবং আরজালকে সম্মিলিতভাবে পাসমান্ডা (যারা পিছিয়ে আছে অর্থাৎ পিছিয়ে) বলা হয় যার মধ্যে রয়েছে মুসলিম ধর্মের অনুসারী আদিবাসী (বান-গুজর, তদভি, ভিল, সেপিয়া, বাকরওয়াল), দলিত (মেহতার, ভক্কো, নাট, ধোবি, হালালখোর, গোরকান) এবং অনগ্রসর জাতি (ধুনিয়া, দাফালি, তেলি, বাঙ্কার, কোরি)।
আধুনিক ধ্যান-ধারণা বিরোধী:
তিনি বঙ্গ-ই-দারা বইয়ের ২৫০ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, উঠা ক্ব ফেক দো বাহর গলী মে/নই তহজীব কে অন্ডে হ্যায় গন্দে’….এই লাইনগুলো থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে ইকবাল আধুনিক চিন্তাধারা এবং গণতন্ত্র, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিরোধী ছিলেন। নিজের ছেলেকে আধুনিক শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানো ভিন্ন কথা।ইকবালকে পাকিস্তানের জাতীয় কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি আল্লামা ইকবাল (পণ্ডিত ইকবাল), মুফাকির-ই-পাকিস্তান (পাকিস্তানের চিন্তাবিদ), শায়ার-ই-মাশরিক (প্রাচ্যের কবি) এবং হাকিম উল উম্মত (উম্মাহর পণ্ডিত) নামেও পরিচিত। ভারতেও তার লাখ লাখ অনুসারী রয়েছে।
আপনারা জেনে অবাক হবেন যে জিন্নাহ ছিলেন একজন শিয়া মুসলিম। ইকবাল ছিলেন আহমদীয়া মুসলিম, অর্থাৎ উম্মাহর কারণে পাকিস্তান গঠনে সুন্নি মুসলমানদের সাথে শিয়া মুসলমান এবং আহমদী মুসলমানরাও ছিলেন । কিন্তু যখন পাকিস্তান গঠিত হয় পাকিস্তানি পার্লামেন্ট থেকে আইন করে আহমদীদের কাফের ঘোষণা করা হয়, পাকিস্তানে আহমদী শিয়াদের কী হচ্ছে, সবই তাদের অপকর্মের ফল। আবদুস সালাম,ইসলামিক বিশ্বের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী, তিনিও একজন আহমদিয়া মুসলিম ছিলেন যিনি পাকিস্তানকে একটি পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত করার কৃতিত্ব দেন, তিনি তার বাকি জীবন ব্রিটেনে কাটিয়েছিলেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন । সেখানে তার কবরও উপড়ে ফেলা হয়। তাহলে যারা আজও ইকবালের মতো লোকদের মহিমান্বিত করে, তারা কি ভারতের বিশ্বাসঘাতক নয়? রঘুরাজ প্রতাপ সিং ওরফে রাজা ভাইয়া জি অস্ট্রেলিয়া-শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার এবং উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মিথ্যার মুখোশ ছিঁড়ে দিয়েছিলেন খাস উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় ।।