মারিয়ান বাচমেয়ার(Marianne Bachmeier) জার্মানির লুবেকের বাসিন্দা ছিলেন। মারিয়ান বাচমেয়ার জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনির হিলডেশেইমের একটি ছোট শহর সারস্টাড্টে বড় হয়েছেন। মারিয়ানের বাবা প্রচুর মদ্যপান করতেন এবং নেশাগ্রস্ত অবস্থায় আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতেন । মারিয়ানের সাথেও হিংসাত্মক আচরণ করতেন তিনি । তার বাবার আগ্রাসী মনোভাবের কারণে তার পিতামাতার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। মা আবার বিয়ে করেন এবং তারপর মারিয়ানকে বাড়ি থেকে বের করে দেন।
জীবন চলতে চলতে, মারিয়ান বাচমেয়ারের যখন ১৯ বছর বয়স, তখন একজন ব্যক্তির সাথে তার দেখা হয় এবং ওই ব্যক্তিকে বিয়ে করেন । বিয়ের পর একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয় তার । মেয়েটির নাম রাখা হয়েছিল আনা। এর পরে, যখন তিনি তার স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স পেয়েছিলেন, তখন শিশুকন্যা আনা হয়ে ওঠে মারিয়ানের জীবনের সবকিছু । কিন্তু মারিয়ান একা, মেয়েকে বাড়িতে রেখে তাকে কাজে যেতে হত । এমন পরিস্থিতিতে মেয়ে আনাকে প্রায়ই বাড়িতে একা থাকতে হতো। মেয়েটির যখ৷ সাত বছর বয়স তখন যে প্রায়ই পাশের বাড়িতে খেলতে যেত, কিন্তু একদিন যখন সে গেল, সে আর ফিরে এল না। এই তারিখটি ছিল ১৯৮০ সালের ৭ মে । মারিয়ান ফিরে এলে আনাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। অবশেষে তিনি নিখোঁজ অভিযোগ দায়ের করেন । পুলিশও খোঁজাখুঁজি করেও কিছু পায়নি।
একদিন এক ব্যক্তি পুলিশকে খবর দিয়ে অন্য একজনের ওপর সন্দেহ প্রকাশ করে । এই ব্যক্তি এর আগে যৌন শোষণ মামলায় জেলে গিয়েছিলেন। পুলিশ ওই ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রথমে প্রতারণার চেষ্টা করলেও তাকে কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে সব খুলে বলে। সে জানায়, মেয়েটিকে ধর্ষণ করে, খুন করে লাশ খালে ফেলে দেয়। বিষয়টি আদালতে গেলেও এখানে সে নিজের বয়ান পরিবর্তন করে । নিজেকে নপুংসক বলতে শুরু করে ধর্ষক-ঘাতক । আদালতে বেশ কয়েকবার শুনানি হয় এবং প্রতিবারই আনার মা মারিয়ান সেখানে যেতেন। মারিয়ান মনে করেছিলেন যে অভিযুক্ত আদালতকে বিভ্রান্ত করছে এবং সে সহজেই পালিয়ে যেতে পারে।
এমতাবস্থায় মেয়ের ন্যায়বিচারের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন মেরিয়ান । ১৯৮১ সালের ৬ মার্চ নিজেকে বিচারের জন্য প্রস্তুত করে আদালত কক্ষে পৌঁছান তিন । এর পরই কেঁপে ওঠে আদালত। মারিয়ান ১.২২ ক্যালিবার বেরেটা পিস্তল নিয়ে আদালত কক্ষে পৌঁছে মেয়ের ধর্ষক-ঘাতক ক্লাউস গ্রাবোস্কির দিকে গুলি চালায়। তিনি মোট ৮টি গুলি ছোড়েন। অভিযুক্ত গ্রাবোস্কি সেখানে মারা যায় মামলাটি ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ এবং পাবলিক বিতর্কের জন্ম দেয়।কিন্তু আদালত কক্ষে হত্যাকাণ্ড করার পর, মারিয়ানের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয় . ফলস্বরূপ, বাচমেয়ারকে হত্যা এবং বেআইনিভাবে একটি আগ্নেয়াস্ত্র রাখার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তাকে ৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যদিও তিনি ৩ বছর পর মুক্তি পান।
এই ঘটনার পর মারিয়েন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অনেক সমর্থন পেয়েছেন। তার সমর্থনে বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়েছিল। তাকে একজন ‘নায়ক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, কারন তিনি নিজেই তার মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের শাস্তি দিয়েছেন । কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মারিয়ান বাচমেয়ার ১৯৮৫ সালে একজন শিক্ষককে বিয়ে করেন। তিন বছর পরে, তারা নাইজেরিয়ার লাগোসে চলে যান এবং একটি জার্মান ক্যাম্পে বসবাস করতেন যেখানে তার স্বামী একটি জার্মান স্কুলে পড়াতেন। ১৯৯০ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। সিসিলিতে স্থানান্তরিত হওয়ার পর , মারিয়ান পালেরমোতে একটি ধর্মশালায় সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হন । তিনি সিসিলিতে অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং তারপরে ফের জার্মানিতে ফিরে আসেন। কিন্তু মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান তিনি । তাকেও তার মেয়ের পাশে কবরস্থ করা হয়।
মারিয়ান সারা দেশে আলোচিত হয়েছিল এবং এই ঘটনাটি এতটাই বিখ্যাত হয়েছিল যে এটির উপর একটি নাটক, তিনটি চলচ্চিত্র এবং তিনটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল জার্মান চলচ্চিত্র ‘নো টাইম ফর টিয়ার্স’, যা ম্যারিওনের জীবনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল।।