এইদিন ওয়েবডেস্ক,০৬ আগস্ট : তালিবানি কায়দায় শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে বাংলাদেশ জামাত-এ-ইসলামি । তিনি বর্তমানে ভারতের আশ্রয়ে আছেন । হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর ব্যাপক হামলা হচ্ছে । মন্দিরে হামলা হয়েছে, হিন্দু নেতা ও সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ‘গণভবন’-এ প্রাক্তন মহিলা প্রধানমন্ত্রীর ব্রা এবং ব্লাউজ নিয়ে উল্লাস করতে দেখা গেছে জামাত জঙ্গিদের । অথচ ভারতের অনেক বামপন্থী/ইসলামী সাংবাদিক এটাকে ‘গণতন্ত্র ও যুবশক্তির বিজয়’ হিসেবে প্রচার শুরু করেছেন । মহম্মদ জুবেরে মত কট্টর ইসলামি সাংবাদিকরা এই বলে প্রচার করতে ব্যস্ত যে বাংলাদেশের হিন্দুদের বা মন্দিরে উপর কোনো হামলাই হয়নি ।
সমগ্র আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিবারের জন্য সংরক্ষণের অবসান ঘটানোকে কেন্দ্র করে । এখানে প্রশ্ন হলো যে বাংলাদেশকে অস্থির করতে কোনো বিদেশী শক্তির হাত আছে কিনা । আসলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, পর্দার আড়ালে প্রায়ই অনেক কিছু ঘটে থাকে, যার অনেক কিছু দৃশ্যমান হয় না। বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তনের নেপথ্যে যে ব্যক্তির ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, তিনি আর কেউ নন, বরঞ্চ তিনি হলেন ডোনাল্ড লু(Donald Lu)। ডোনাল্ড লু একজন আমেরিকান কূটনীতিক যিনি বর্তমানে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার সহকারী বিদেশমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন । ইতিমধ্যেই তিনি পাকিস্তান,শ্রীলঙ্কা, আলবেনিয়া, কিরগিজস্তান প্রভৃতি দেশের সর্বনাশ করেছেন । তার কীর্তির তালিকায় যোগ হল বাংলাদেশের নামও । এবারে তিনি বাংলাদেশের মত ভারতের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে ভারতের সর্বনাশ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন ।
পুনে-ভিত্তিক ‘গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজি ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর অনন্ত ভাগবত ২০২৪ সালের মে মাসে বলেছিলেন যে ডোনাল্ড লু ভারতে ঘৃণার বস্তু হয়ে উঠেছেন কারণ তিনি ভারতীয় গণতন্ত্রে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছেন । ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে, খবর আসে যে ভারতের বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী আমেরিকার হোয়াইট হাউসে একটি গোপন বৈঠক করেছেন। সেখানে ডোনাল্ড লুও উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। যদিও ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কাছে এই সংক্রান্ত কোনও তথ্য নেই।
সমগ্র বিশ্বের মানবাধিকারের দায়িত্বে নিয়ে বসে থাকা আমেরিকার সহকারী বিদেশমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ভারতে মোদী সরকারের আমলে মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন । ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মাঝখানে ডোনাল্ড লু যখন এখানে এসেছিলেন তখন ভারতের অনেক মানুষ হতবাক হয়েছিলেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায়ও যান। ডাঃ অনন্ত ভাগবত তখন বলেছিলেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ভারতের স্থিতিশীল সরকার চায় না, কারণ মোদি সরকারের এক দশকে ভারতের বিদেশনীতি শক্তিশালী হয়েছে, নিজস্ব শর্তে চলছে এবং স্থিতিশীল হয়েছে। তবে লোকসভা নির্বাচনের মাঝখানে, ডোনাল্ড লু জাতীয় রাজধানী নয়াদিল্লিতে নয় বরং তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাই যান, যেখানে দ্রাবিড় রাজনীতির প্রাধান্য রয়েছে এবং বিজেপি লড়াইয়ে নেই। আর তখনই তামিলনাড়ুর শাসক দল ডিএমকে-র নেতাদের কাছ থেকে দেশকে ভাগ করে আলাদা দেশ ‘দ্রাবিড়নাডু’ তৈরির দাবি ওঠে । আমেরিকার পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় যে তিনি ‘দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতে’ চেন্নাই গিয়েছিলেন ডোনাল্ড লু। যদিও তার উদ্দেশ্য ছিলে ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আবহাওয়ার সৃষ্টি করা । লু তখন বাংলাদেশেও গিয়েছিলেন, যেখানে শেখ হাসিনা সবেমাত্র চতুর্থবার জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরেছেন । সেই সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিরুদ্ধে নির্বাচন বয়কট করা বিরোধী দল বিএনপিকে সমর্থন করার অভিযোগ ওঠে ।
তখন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠরা সন্দেহ প্রকাশ যে আমেরিকা ক্রমাগত ঢাকাকে চীনের বিরুদ্ধে লবিংয়ে জড়িত করতে চাইছে । ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে তার পাশে নিয়ে আসার জন্য ক্রমাগত নিয়োজিত ছিল আমেরিকা। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশেরও মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল আমেরিকা। ডোনাল্ড লু যখন ২০২৩ সালের মার্চ মাসে মার্কিন ‘সেনেট ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির’ সামনে হাজির হন, তিনি ভারতে মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছিলেন। তিনি জম্মু ও কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচনের অনুপস্থিতি এবং ‘চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘন’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যাতে জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ইন্ডি জোটের পালে হাওয়া লাগে । মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কথিত বৈষম্যের কথা বলে বাজার গরম করে দেন ডোনাল্ড লু ।
ডোনাল্ড লু বলেছিলেন যে তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণাধীন সামুদ্রিক অঞ্চলে ভারতীয় জাহাজ দেখা গেছে এবং তাইওয়ানের সুরক্ষার বিষয়ে আশ্বাস দেওয়ার ক্ষেত্রে এটি প্রতীকীভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতেউ স্পষ্ট যে আমেরিকা ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। তিনি জম্মু ও কাশ্মীরে ‘বড় সাংবাদিকদের’ গ্রেফতার করার দাবি করেছিলেন। কাশ্মীরিদের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য আমেরিকা এই বিষয়ে ভারতকে চাপ দেবে বলেও বলা হয়েছিল। প্রসঙ্গত,এযাবৎ কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের সাহায্য করার জন্য ৭০ জন সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। যারা দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, ফাহাদ শাহ সন্ত্রাসবাদকে মহিমান্বিত করার কারণে ‘কাশ্মীর ওয়ালা’ নামে একটি মিডিয়া সংস্থার সম্পাদককে জেলে পাঠানো হয়েছিল।
পাকিস্তানেও, ২০২২ সালের এপ্রিলে, নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল এবং একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল যাতে অনেক দলের জোট অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন ইমরান খান নিজেই অভিযোগ করেছেন যে বিদেশি হস্তক্ষেপের কারণে তাকে অপসারণ করা হয়েছে এবং এতে ডোনাল্ড লুর হাত ছিল। বলা হচ্ছে, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যেই রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ইমরান খান রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে শুরু করার কারণেই ক্ষুব্ধ হয় আমেরিকা । এ বিষয়ে ডোনাল্ড লুকে প্রশ্ন করা হলে তিনি এটিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বলে অভিহিত করেন। তিনি এই অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলেন। আসলে ডোনাল্ড লুর এসব কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে আমেরিকার ‘ডিপ স্টেট’ দক্ষিণ এশিয়ায় তার আধিপত্য বাড়াতে চায়।
ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে ‘রাজনৈতিক সংস্কার’ নিয়েও কথা বলেছেন এবং শেখ হাসিনার দল ‘আওয়ামী লীগ’ খালেদা জিয়ার প্রতি আমেরিকান সমর্থনের বিষয়ে আওয়াজ তুলেছিল । আজ সেখানে আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে। এবার আসা যাক শ্রীলঙ্কার কথায় । আমেরিকা ও চীনের খেলায় মাঝখান থেকে ফেঁসে যায় শ্রীলঙ্কাও। আমরা ২০২২ সালের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কায় একই ছবি দেখেছিলাম যা আমরা আজ বাংলাদেশে দেখছি। বিক্ষোভকারীরা শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢুকে সুইমিং পুলে স্নান করছিলেন। ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছিল । আসলে ঋণ দিয়ে কার্যত কিনে নেওয়া শ্রীলঙ্কাকে নিজের পালে টানতে মরিয়া হয়ে ওঠে আমেরিকা। শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভেরও একই পরিণতি হয়েছিল যেমনটা বাংলাদেশের হল । গোটাভায়া রাজাপাক্ষকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। তার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়। আজ আমেরিকা কলম্বো ওয়েস্ট টার্মিনাল বন্দরকে অর্থায়ন করছে । ইউএসএআইডি-এর মাধ্যমে শ্রীলঙ্কাকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। ইউএসএআইডি একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, আসলে শাসন পরিবর্তনের জন্য এই অর্থায়ন করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে । ‘নতুন’ শ্রীলঙ্কার প্রশংসা করতে গিয়ে ডোনাল্ড লু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ভারত-বাংলাদেশকে সতর্ক করেছিলেন । আসলে রোহিঙ্গা হল ভারতের মূর্তিমান সমস্যা ।
শুধু তাই নয়, আলবেনিয়ার যুবকদের ভালো জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের খেপিয়ে দিয়ে আসে ডোনাল্ড লু । কিরগিজস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত থাকার সময় সেখানেও রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি করে দিয়ে আসেন । যার জেরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সোরনবে শিরিপোভিচ জিনবেকভকে পদত্যাগ পর্যন্ত করতে হয় । কিরগিজস্তান ও আলবেনিয়ার উত্তেজনা সৃষ্টির পিছনে যুক্ত ছিলেন ডোনাল্ড লুও ।
এখন প্রশ্ন যে ডোনাল্ড লু কি ভারতে এমন কিছু করতে চান যাতে ভারতের দশাও পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মত হয় ? তবে তার এটি ভারতে করা খুব কঠিন কারণ এটি একটি বিশাল দেশ যেখানে সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির নিজস্ব অর্থনীতি রয়েছে। এখানে প্রতিটি অঞ্চলে মানুষের আয়ের উৎস এবং অগ্রাধিকার পরিবর্তন হতে থাকে, কৃষিই একমাত্র পেশা যা সমগ্র দেশকে একত্রিত করে। তবুও, আমেরিকার ডিপ স্টেট শক্তিশালী মোদী সরকারের চেয়ে ভারতে জোট-বিজেপি-বিরোধী সরকারকে পছন্দ করবে। এর জন্য পরিবেশ তৈরি হতে শুরু করেছে। ‘অগ্নিবীর’ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছিল, এনিয়ে পার্লামেন্টে প্রকাশ্যে মিথ্যা কথা বলেছিলেন রাহুল গান্ধী । বর্ণ শুমারি নিয়ে হিন্দুদের বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। রাহুল গান্ধী সংসদে বলেছিলেন যে তিনি জাতিশুমারি করবেন। ‘কৃষক আন্দোলনের’ সময় আমরা লাল কেল্লায় খালিস্তানি পতাকা দেখেছিলাম, দিল্লির সীমানা এক বছর ধরে ঘেরাও ছিল। আজও পাঞ্জাব-হরিয়ানার শম্ভু সীমান্তে অনেক কৃষক বসে আছেন। এগুলি এমন সমস্ত বিষয় যা দেশের জনগণের একটি বড় অংশকে উত্তেজিত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ।।