স্বাধীন ভারতের তথাকথিত সেকুলার শাসক ইতিহাসের পাতায় ভরিয়ে দিয়েছে মুঘল হানাদার বাবর, আকবরের গুণকীর্তন করতে করতে । যেকারণে দেশের অগনিত বীরযোদ্ধাদের নাম আজ কেউই জানেন না । ষোড়শ শতকের এক বাঙালি ব্রাহ্মণ রাণী, ‘ননদিনী রায়বাঘিনী’ বা রাণী ভবশঙ্করীর শৌর্য এবং বীরত্বের কথা বেমালুম ভুলে গেছে আত্মবিস্মৃত বাঙালি । মাতা চণ্ডীর উপাসক রাণী ভবশঙ্করী অস্ত্র চালনা, ঘোড়ায় চড়া, তীরন্দাজিতে পারদর্শিনী এবং শাস্ত্রে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন বলে জানা যায়। স্বদেশী শাস্ত্রের প্রতি ছিল তাঁর অপার আগ্রহ ।
ভূশুট রাজ্যের রাণী ছিলেন ভবশঙ্করী । পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান হাওড়া, হুগলি, অবিভক্ত মেদিনীপুর,অবিভক্ত বর্ধমানসহ বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে ছিল প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভূশুট বা ভুরশুট রাজ্য । এই রাজ্যের রাজা রুদ্রনারায়নের স্ত্রী ছিলেন ভবশঙ্করী । গ্রাম্য জমিদারের কন্যা ভবশঙ্করীর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহ করেন রাজা রুদ্রনারায়ণ । রাজা রুদ্রনারায়ণ পরলোকগত হন হত তখন তাঁদের একমাত্র ছেল প্রতাপনারায়র বয়স মাত্র ৫ বছর । রাজার মৃত্যুর পর রাজ্যের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নেন রানী । তবে স্বামীর মৃত্যুর পর তিন মাস ব্রহ্মচারিণী ব্রত পালন করেছিলেন রাণী ভঙ্করী। কাষ্ঠসাংড়া শিবমন্দিরে রাণী ভবশঙ্করী (রাণী ভবশঙ্করী) শৈব সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন ।
পরে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রাজ্যশাসন পরিচালনা করেন তিনি । আধ্যাত্মিক জীবন ছাড়াও রাণী ভবশঙ্করী রাজ্যের ব্যবস্থাও ঢেলে সাজানো শুরু করেন । তাঁর সময়ে শৌর্যে-বীর্যে, কৃষি, বাণিজ্য, তাঁর শিল্প ও ধাতু শিল্পে সমৃদ্ধি উঠতে শুরু করে ভূশুট রাজ্য। একথায় রাজ্যে তখন স্বর্ণযুগ।
এইসময় ভুরশুটের অধিবাসী পাঠান সর্দার ওসমান খাঁ মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়। ওসমান যুদ্ধের জন্যে রানীর সাহায্য চায় কিন্তু ভবশঙ্করী রাজী না হলে সে ভুরশুট রাজ্য আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে।ওসমান খানের সেনারা হিন্দু সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ভুরশুট রাজ্যে প্রবেশ করেন। এছাড়াও বহু পাঠান সৈন্য ব্যবসায়ী, পর্যটক, ফকির ইত্যাদি ছদ্মবেশে প্রবেশ করেন। কিন্তু বর্তমান হাওড়া জেলার আমতার দুর্গে থাকা সেনা রানীর গোয়েন্দারা পাঠান সেনাদের চিনতে পারে। তারাই রানী ভবশঙ্করীকে পাঠান সেনার আগমনের খবর পৌঁছে দেয়।
রানী ভবশঙ্করী এই সংবাদ পাওয়া মাত্রই পাঠান সেনাদের প্রতিহত করার পরিকল্পনা করেন। সেই মতো তিনি আশেপাশের দুর্গগুলি থেকে দক্ষ সেনাদের ডেকে নেন এবং তাদের আশেপাশের জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে আচমকা হামলার নির্দেশ দেন । কিছু বিস্বস্ত মহিলা সেনাদের নিজের কাছে রাখেন রানী। রাতে রানী ভবশঙ্করী যুদ্ধের পোশাক পরে, অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মাতা চণ্ডীর পূজায় বসেন। পূজায় বসার সময় তিনি নিজের শরীরে একটি সাদা কাপড় জড়িয়ে নেন। গভীর রাতে ওসমান খানের সেনাবাহিনী রানী ভবশঙ্করীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মন্দিরে আক্রমণ করেন। কিন্তু সেনারা প্রস্তুত থাকায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। রানী ভবশঙ্করীর নেতৃত্বে থাকা সেনারা পাঠান সেনাদের খণ্ডবিখণ্ড করেন। রাণী ভবশঙ্করীর হাতে ছিল দেবী রাজবল্লভীর স্বপ্নাদিষ্ট তরবারি। ওসমান খান পরাজিত ও খতম হয় । পিছনে থাকা পাঠান সেনাদের একটি দল কিছু দূরের গ্রামে থাকা একটি শৈব সাধুদের আখড়ায় আক্রমণ করেন। কিন্তু শৈব সাধুরা পাঠানদের তরোয়ালের জবাব তরোয়ালের দ্বারাই দেন। সেখানে শৈব সন্ন্যাসীরা বহু পাঠান সৈন্যকে হত্যা করেন।
রানী ভবশঙ্করীর বীরত্বের কথা পৌঁছায় তৎকালীন মোগল সম্রাট আকবরের কানে । তিনি মানসিংহকে ভুরশুটে পাঠান রাণী ভবশঙ্করীর কাছে। দু’পক্ষের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় । ঠিক হয়, কেউ কারোর রাজ্য আক্রমণ করবে না । ঐতিহাসিকদের মতে, এই সময়ই সম্রাট আকবর বীরাঙ্গনা রাণী ভবশঙ্করীকে “রায়বাঘিনী” উপাধিতে ভূষিত করেন ।
রাণী ভবশঙ্করীর জন্মসাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য পাওয়া তথ্য পাওয়া যায় না । তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ কন্যা। পিতা দীননাথ চৌধুরী ছিলেন পেড়োর জমিদারের অধীনস্থ পেড়ো দুর্গের সেনাপতি। বেশ লম্বা-চাওড়া চেহারার মানুষ ছিলেন দীননাথ। রণকৌশলে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। ভূরিশ্রেষ্ঠ নগর গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি ।দীননাথের দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছিলেন ভবঙ্করী। ভবশঙ্করীর ছোট ভাইয়ের জন্মের সময় মৃত্যু হয় । শৈশব ও বাল্য কালে ভবশঙ্করী অস্ত্রবিদ্যা, ঘোড়ায় ও বীরন্দাজিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন । কূটনীতি, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব পাঠ ও দর্শনে অগাঢ় পান্ডিত্য অর্জন করেন । কথিত আছে ভবশঙ্করী (রাণী ভবশঙ্করী) দামোদর ও রণ তলীর অঞ্চলে শিকারে যান। আকাশই হরিণকে তাড়া করার সময় একটি বুনো বাইসন আক্রমণ করে তাঁকে। ভবশঙ্করী এক হাতেই মেরে ফেলতে সক্ষম হন বাইসনটাকে ।
ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজবংশের কুলদেবী ছিলেন রাজবল্লভী। জানা যায়, চণ্ডীর একটি রূপ দেবী রাজবল্লভীর নাম ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের পুরোনো মানালের রাজবলহাট নামকরণ হয়। ধার্মিক রাণী, দেবী রাজবল্লভীর অষ্টধাতুর মূর্তি করান। দেবীর কাছে মানত করে তিনদিন উপবাস থাকার পর রাণী ভবশঙ্করী গড়- ভবানীপুরের একটি পুকুরে স্নান করতে যান। কথিত আছে, সে সময়ই তিনি জল থেকে লাভ করেন দেবীর দেওয়া তরবারি। এই তরবারি হাতে থাকলে তিনি পরাস্ত হতেন না, এটা দেবী রাজবল্লভীর বর। আর দেবীর আশীর্বাদে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাণী ভবশঙ্করী ছিলেন অপরাজিতা । তবে রানীকে প্রধান সেনাপতি চতুর্ভূজ চক্রবর্তীর বিশ্বাসঘাতকরা মধ্যে পড়তে হয় । ভূশুট রাজ্যের রাজা করার শর্তে চতুর্ভূজ চক্রবর্তী হাত মিলিয়েছিলেন মেলান সর্দার ওসমান খানের সঙ্গে। কিন্তু তার সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেন রাণী ভবশঙ্করী । শেষ বয়সে ছেলে প্রতাপনারায় হাতে হাতে রাজপাট ছেড়ে কাশীবাসী হয়েছিলেন রায়ঘিনী রাণী ভবশঙ্করী। তাঁর স্মরণে ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর হাওড়া উদয়নপুরে আয়োজন করা হয় “রায়বাঘিনী ভঙ্কশরী” মেলার ।।