টাকা পয়সার অভাবে ক্লাস সিক্স পাশ করে মিতার আর পড়া হয়নি। উনিশ ব ছর বয়সে তার বিয়ে হলো কলকাতার রানীকুঠিতে মলয় এর সাথে। মলয়ের মা আছেন, বাবা গত হয়েছেন। ছোট্ট একতলাতলা একটি বাড়ি আছে। চাকরি করে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। সুখের সংসার পেতেছিলো মিতা। শাশুড়ি খুব ভালো। যতটা পারেন সংসারের কাজকর্ম করেন, মিতাকে নিজের মেয়ের মত ভালবাসেন।
বিয়ের পর খুব সকালে উঠে প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে রান্নাঘরে চলে আসে মিতা। শাশুড়ি একদিন বলেন,-এতো ভোরে উঠে স্নান করো কেন বৌমা? ঠান্ডা লেগে যাবে যে। আমার সকালে ওঠা অভ্যেস হয়ে গেছে। তুমি ছেলেমানুষ বিছানায় শুয়ে থেকো কিছুটা সময়। সকালে আমি কিছুটা রান্না এগিয়ে রাখবো পরে যদি কিছু রান্না করতে তোমার ইচ্ছে হয় তুমি করো কেমন?’
মিতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে ও বলে,-‘ মা আমাদের বয়স কম, সহ্য শক্তি বেশি। আপনার তো বয়স হচ্ছে, আপনি ও এত সকালে উঠবেন না। আপনার ছেলেকে বলেছি ও অফিস থেকে লোন নিয়ে একটা ফ্রিজ যেন কেনার চেষ্টা করে।’
‘তাহলে তো ভালই হবে বৌমা রাতে কিছুটা রান্না করে রেখে দিলে, সকালে খোকার টিফিন, ভাত, আর টুকটাক ভাজাভুজি করে নিলেই হবে।’
‘তাই হবে মা।’
কয়েক মাস পর মলয় অফিস থেকে লোন নিয়ে ফ্রিজ কিনে আনে। দিব্যি আনন্দের সাথে কেটে চলেছে দিনগুলো। শাশুড়ি,পাড়া প্রতিবেশী সবাই মিতা কে ভালোবাসেন। বিয়ের এক বছরের মধ্যে প্রেগন্যান্ট হয় সে। শাশুড়িকে প্রথমে জানায়।
শাশুড়ি বলেন,-‘এতো খুব ভালো খবর মা। খোকাকে তুমিই বলো নিজের মুখে,খুব খুশি হবে। আর মা তোমাকে যে এবার খুব সাবধানে থাকতে হবে। খালি পেটে থাকা চলবে না। দুধ, মাছ, ফল এগুলো খেতে হবে। খোকা আমার চৌকস আছে, এই খবর জানতে পারলে আগেই তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।’
মলয় সুখবরটি শুনে জিজ্ঞেস করে,-তাই নাকি মিতা? আমাদের দুজনের মাঝে আরো একজন আসছে? এই সপ্তাহে তোমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো। এখন খুব সাবধানে থেকো কিন্তু। তুমি তো একদম ফল খেতে চাও না। এবার একা নও দুটো প্রাণ একসাথে থাকছে, তাই আমি ফল এনে দিলে খেয়ো।’
‘অভাবের সংসারে তুমি কোনদিন ফল খাও না, আমি কি করে খাবো বলো? আর এমনিতে ফল খেতে আমি ভালোবাসি না। মাঝে মাঝে তুমি আঙ্গুর, আপেল,কলা আনো পুজোর জন্য। আমি কিন্তু ঠাকুর পূজোর বাতাসা খাই, ফল আমার ভালো লাগেনা।’
‘এখন ওসব বললে চলবে না মিতা। তোমার শরীরের প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে তোমায়। এ সময় পরিমিত ঘুমটাও দরকার’…..
যথাসময়ে মিতার কোল আলো করে একটি পুত্র সন্তান আসে। মিতার ছেলে ধ্রুব যখন এক বছরের হয়, একটি বৃষ্টি ভেজা শ্রাবণের রবিবার রাতে হঠাৎ মলয় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মিতা ঠাকুরের কাছে গিয়ে মেঝেতে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলে তার হাতের শাঁখা। ঠাকুরের সামনে একটি বাটিতে ধুয়ে-মুছে ফেলে কপাল এর ও সিঁথির সিঁদুর।
মিতা ঠাকুর কে উদ্দেশ্য করে বলে,-‘আমার সুখ তোমাদের সহ্য হলো না তো? কেড়ে নিলে আমার সিঁথির সিঁদুর!তোমরা এত নির্দয় কেন ঠাকুর!’
যতটুকু টাকা-পয়সা ছিলো তাই দিয়ে কোনরকমে মলয় এর কাজ সম্পন্ন হয়। বাড়িতে বয়স্ক শাশুড়ি ছোট বাচ্চাকে রেখে, মিতা কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। বিভিন্ন অফিসে ঘুরে তার সামান্য পড়াশোনার যোগ্যতায় পেলো না কোন চাকরি। তাই বাধ্য হয়ে মুড়ি ফ্যাক্টরিতে মুড়ি ভাজার কাজে যুক্ত হলো। শাশুড়ি, বাড়িতে মিতাকে কোন কাজ করতে দেন না। ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে ছেলে ও শাশুড়ির সাথে অল্প কিছুটা সময় কাটিয়ে, খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে মিতা।
একদিন মুঠো ফোনে মিতার মা বলেন, -এই ভাবে কতদিন চলবে মিতা? সামনে সারাটা জীবন পড়ে আছে। তুই তো বিয়ে করার কথা চিন্তা করতে পারিস।’
মিতা উত্তর দেয়,-আর কোনদিনও কথা বলোনা মা। আমার কথাটাই শুধু চিন্তা করলে? আমার ছেলে আমার শাশুড়ির কথাটা একবার চিন্তা করলে না? আমার শাশুড়ির কি হবে! আমার ছেলে কে কি কেউ তার বাবার মতো ভালবাসতে পারবে?’
মিতার শাশুড়ির কানে কথাগুলো আসে। কিছুক্ষণ পর তিনি মিতার কাছে এসে বলেন,-‘তোমার মা তো ঠিক কথা বলেছেন বৌমা। তুমি বিয়ে করো,আমার জন্য চিন্তা করো না। একা কোনরকমে কাটিয়ে দেবো বাকি জীবনটা! তুমি আর আমার নাতিটা ভালো থাকলেই আমি সুখী হবো।’
‘আপনি বুঝলেন কি করে মা,আমরা সুখী হবো? এতো অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না। তাছাড়া আপনার প্রতিও তো আমার একটা কর্তব্য আছে, সেটাই বা ভুলি কি করে?’
মিতার শাশুড়ির চোখ দিয়ে নেমে আসে আনন্দাশ্রু। বলেন,-তুমি আমার বউমা নও, তুমি আমার মেয়েও নও, তুমি আমার মা। মা ছাড়া আর তোমাকে কার সাথে তুলনা করবো বলো?’
অনেক দুঃখ কষ্টে বছরের পর বছর কাটিয়েছে মিতা। ছেলে এখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। অরিজিৎ অপেক্ষায় আছে সেই দিনটির জন্য, যেদিন থেকে আর তার মাকে লোকের বাড়িতে কাজ করতে হবে না।
অরিজিৎ এর ঠাম্মা একদিন অরিজিৎ কে বলেন, দাদুভাই তুই চাকরি পাবি, বিয়ে করবি, তোর বউ দেখে তারপর আমি পরপারে যাবো। এর আগে কিন্তু আমি যাচ্ছি না।’
অরিজিৎ বলে,- ‘তুমি এখন কোথায় যাবে ঠাম্মি? এতো সহজে তোমার ছুটি পাওয়া হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে মনের আনন্দে থেকো। মন ভালো থাকলে দেখবে শরীর ও ভালো থাকবে। আমাদের জন্য আরও অনেক বছর তোমায় বেঁচে থাকতে হবে।’
অরিজিৎ কে ঠাম্মি বলেন,- দাদুভাই আমার কথা ছাড় তোর মায়ের দিকে লক্ষ রাখিস। কোনদিন কোন কষ্ট পেতে দিবি না তোর মা কে। তুই চাকরি পাবার পর হতভাগী যেন সুখী হতে পারে। কম বয়সে বিয়ে করে তিন বছরের মধ্যে স্বামীকে হারিয়ে, হৃদয়ে যন্ত্রণা নিয়ে ধরেছে এই সংসারের হাল। এই কষ্টের মর্যাদা যেন পায় তোর মা। তবেই তোর বাবার আশীর্বাদও তুই পাবি।’।