তুরস্কের একটা ছোট্ট গ্রাম ফুলাসিক(Fulacik)। পশ্চিম তুরস্কের নিসিয়ার (ইজনিক) প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরে বিথিনিয়ার ঐতিহাসিক অঞ্চলে অবস্থিত এই প্রাচীন গ্রামটি । গ্রামের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১,৬০০ জন, সমস্ত গ্রীক সম্প্রদায়ের ৷ তুর্কিরা গ্রামটিকে কুকুক ইউনান বা অন্য কথায় লিটল গ্রিস বলে উল্লেখ করত । কিন্তু আজ থেকে প্রায় ১০৪ বছর আগে ১৯২০ সালের ২৩ জুন ফুলসিককে গ্রীক শূণ্য করতে নৃশংস নরসংহার চালায় ইসলামি কেমালবাদীরা (Kemalists) । তুর্কির কেমালিজম যা আতাতুর্কিজম নামেও পরিচিত । মুস্তফা কামাল আতাতা এর প্রতিষ্ঠাতা । কামাল আতাতুর্ক কর্তৃক প্রবর্তিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নীতি এবং অটোমান সাম্রাজ্যের একটি অংশ থেকে একটি আধুনিক প্রজাতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ তুর্কি রাষ্ট্র গঠনের জন্য এটি গঠন করা হয় ।
কিন্তু মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও গোষ্ঠীটি ছিল কট্টর ইসলামি মতাদর্শে বিশ্বাসী । ১৯২০ সালের ২৩ জুন সকালে ফুলসিকে হামলা চালায় কেমালবাদীরা (Kemalists) । বাসিন্দাদের কাছ থেকে তারা প্রথমে অর্থের দাবি করে । এরপর ১৪ বছরের বেশি বয়সী সমস্ত পুরুষকে সেন্ট জর্জের গির্জার ভিতরে জড়ো করা হয় । যেখানে আগে থেকেই ফাদার ফিলিপোস কালোকিডিসকে দড়ি বেঁধে রেখে দিয়েছিল কেমালিস্ট দলের কমান্ডার কারামুরসেলের কামাল । ফাদার ফিলিপোস অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে কামাল তার একটি চোখ উপড়ে ফেলে । এরপর গির্জায় পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হয় । দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় ফাদার ফিলিপোসসহ কয়েক’শ গ্রীক কিশোরের । ইতিমধ্যে কামালবাদীরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গ্রামের বাকি স্ত্রী-পুরুষদের নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারে ।
পরবর্তী কালে পাভলোস বালিদিস নামে গণহত্যার এক প্রত্যক্ষ্যদর্শী বর্ণনা করেছিলেন, তুর্কিরা সব ঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল,তারা আমার বাড়িতে এসে আমার ঘোড়াগুলো দরজায় বেঁধে পেট্রোল ঢেলে জীবন্ত জ্বালিয়ে দিল। আমার বাড়িটি শীঘ্রই আগুনে নিমজ্জিত হয়েছিল, তাই আমরা দ্রুত পিছনের দেয়ালের গর্ত দিয়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসি । আমরা গলি পথ দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেলাম। তখন দেখতে পাই বাড়িগুলির দেওয়ালে ফাটল ধরেছে এবং একের পর এক বাড়ি থেকে বিস্ফোরণ হচ্ছে। নরসংহার গোটা গ্রাম জুড়ে চলছিল এবং তুর্কিদের চিৎকার ও ইসলামি শপথের শব্দে বাতাস ভরে যায়।’
তিনি বলেছিলেন,আরও কয়েকজন প্রতিবেশীর সাথে আমি যখন গিরিখাতের মধ্যে নামছিলাম, তখন গ্রামবাসীদের মৃতদেহগুলিতে হোঁচট খেয়েছিলাম। উপরের মহলার জলন্ত বাড়িগুলি থেকে আসা আলোয় দেখি আমার প্রতিবেশী অ্যাথানাসিস টোরোনোগ্লো, সোফিয়া টুরোনোগ্লোর সহ আরও অনেকের মৃতদেহগুলি পড়ে রয়েছে । যারা গণহত্যা থেকে রক্ষা পেয়েছিল তারা টানা ৪০ দিন ধরে না খেয়ে পাশের পাহাড়ে লুকিয়ে ছিল, কিছু শুধু গমের উপর বেঁচে ছিল, ক্ষুধার জ্বালায় কাতরানো সন্তানদের হত্যা করেছিল তাদের বাবা-মা, যাতে তাদের কান্না শুনতে না পায় তুর্কিরা । পরে ফাদার ফিলিপোসের লাশ একটি নদীর পাশে ঘাসে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার মুখ বাঁধা ছিল, গলা কাটা এবং আগুনে তার শরীরের সাথে ঘাড়ের চামড়া জুড়ে গেছে ।
ফুলাসিকে গ্রীকদের গণহত্যা ছিল গ্রীক গণহত্যার সময় নিকোমিডিয়া (Tr: Izmit) অঞ্চলের একটি ধারাবাহিক গণহত্যা যা সাধারণত ইজমিট গণহত্যা হিসাবে উল্লেখ করা হয় । তদন্তের একটি অন্তর্বর্তী কমিশন ১৯২১ সালে অঞ্চলটি পরিদর্শন করে এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে ১৯২০ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে অন্তত ১২,০০০ গ্রীককে গণহত্যা করা হয়েছিল।
ফুলসিকের অনেক গ্রীক তুরস্ক থেকে পালিয়ে গিয়ে গ্রিসের কিলকিস অঞ্চলে অবস্থিত ইভ্রোপসে বসতি স্থাপন করে। অন্যরা সেরেস এবং এথেন্সে বসতি স্থাপন করেছিল । ১৯৯২ সালে, গণহত্যার শিকারদের সম্মান জানাতে ইভ্রোপসে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল। পরে ২০১১ সালে স্মৃতিস্তম্ভটি সংস্কার করা হয়েছিল এবং স্থানান্তরিত হয়েছিল যেখানে এটি বর্তমানে সেন্ট জর্জের গির্জার মাঠে অবস্থিত। আসল স্মৃতিস্তম্ভটি ভাস্কর ইফথিমিওস কালভরাস দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছিল এবং বর্তমান স্মৃতিস্তম্ভটি লাজারোস তান্তিস দ্বারা পুনরায় ডিজাইন করা হয় । স্মৃতিস্তম্ভের উপরের অংশে একটি বড় মার্বেল প্লেট গণহত্যার দৃশ্য চিত্রিত করে এবং নীচে সেই গণহত্যাকারীদের নাম রয়েছে। ফাদার ফিলিপোস কালোকিডিসের একটি আবক্ষ মূর্তি ডানদিকে দেখা যাচ্ছে। স্মৃতিস্তম্ভটি পূর্ব থ্রেসের সান্তোতে (বর্তমানে চন্তকয়) গণহত্যাকারীদের সম্মান করে যারা সেখানে পিতার আবক্ষ মূর্তির নিচে উপস্থিত হয়ে নিহতদের নাম উল্লেখ করে। সান্তো থেকে অনেক গ্রীকও তুরস্ক থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর ইভ্রোপসে বসতি স্থাপন করেছিল।
১৯২১ সালের মার্চ মাসে, সাংবাদিক কোস্টাস ফালটাইটস এশিয়া মাইনরে (আজকের তুরস্ক) পৌঁছেন যা গ্রীকো-তুর্কি যুদ্ধে গ্রিসের গতিবিধির খবর সংগ্রহ করার জন্য৷ সংবাদপত্র এমব্রোস দ্বারা পাঠানো হয়েছিল তাকে । যখন তিনি নিকোমিডিয়া (আজকের ইজমিট) অঞ্চলে পৌঁছেছিলেন – একটি বিশাল সংখ্যক গ্রীক, আর্মেনিয়ান এবং সার্কাসিয়ান সম্প্রদায়ের অধ্যুষিত একটি অঞ্চল – কেমালিস্ট বাহিনী ইতিমধ্যে আশেপাশের অনেক শহর ও গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, চারিদিকে ছিল শ্মশানের নিস্তব্ধতা । ফালটাইটরা এই গণহত্যা থেকে পালিয়ে আসা লোকদের মুখোমুখি হয়েছিল এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল যা সেই সময়ে গ্রীক এবং ফরাসি উভয় ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাদের প্রতিবেদনের মধ্যে রয়েছে বেসামরিক নাগরিকদের তাদের গির্জা এবং বাড়িতে ব্যাপক পুড়িয়ে ফেলা, নারীদের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন এবং শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা। বইটিতে নিকোমিডিয়ার আর্মেনিয়ান মেট্রোপলিটন স্টেফান হোভাকিমিয়ানের পর্যবেক্ষণও রয়েছে । ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে এবং টেসা হফম্যানের একটি প্রস্তাবনা সহ, এই সংস্করণটি পারস্পরিক নৃশংসতার দাবিকে পরিপ্রেক্ষিতে রাখে যা এই অঞ্চলে গ্রীক এবং তুর্কি উভয়েই অভিযুক্ত ছিল। বইটিতে বর্ণিত ঘটনাগুলি গ্রীক গণহত্যার অনেকগুলি অধ্যায়ের মধ্যে একটিতে কিছু আলোকপাত করবে, একটি গণহত্যা যা প্রাক্তন অটোমান সাম্রাজ্যে বসবাসকারী প্রায় এক মিলিয়ন গ্রীকের জীবন কেড়ে নিয়েছিল ।।