ভারত হিন্দু বহুল রাষ্ট্র । আর এক হিন্দু বহুল রাষ্ট্র নেপাল, এক সময় কাগজে কলমে হিন্দু রাষ্ট্র বলেই পরিচিত ছিল । মূলত ভারতের উপরেই নির্ভর করত নেপালের অর্থনীতি ৷ ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্কও ছিল সুদৃঢ় । কিন্তু ৮০-এর দশকের শেষের দিকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর ব্যক্তিগত আক্রোশের কারনে নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয় ৷ ক্রমে চীনপন্থী হয়ে ওঠে হিমালয়ের কোলে ছোট্ট ওই হিন্দুরাষ্ট্রটি । আর রাজীব গান্ধীর সেই ব্যক্তিগত আক্রোশের নেপথ্যে ছিল তার এবং তার খ্রিস্টান স্ত্রী সোনিয়ার ধর্ম পরিচয় ।
আসলে ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মতই নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান পৌরাণিক পশুপতিনাথ মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ৷ ইন্দিরা গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে গিয়েছিলেন… কিন্তু মন্দিরের নিয়ম অনুযায়ী যে কোনও অহিন্দুর প্রবেশ নিষিদ্ধ, তাই প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধীকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি এবং ইন্দিরা গান্ধীকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি । তবে তিনি বিষয়টি সহজভাবেই নিয়েছিলেন । ইন্দিরা গান্ধী নিজেই বলেছিলেন যে অহিন্দুকে বিয়ে করার কারণে তিনি আর হিন্দু ছিলেন না । প্রসঙ্গত,ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ছিলেন ফিরোজ জাহাঙ্গীর,একজন পার্সি ।
ইন্দিরা গান্ধীর মতই তার বড় ছেলে রাজীব গান্ধীকে কাঠমান্ডুর পশুপতিনাথ মন্দিরে একই সমস্যার মুখে পড়তে হয় । রাজীব গান্ধী বিয়ে করেন আন্তোনিয়া মাইনো ওরফে সোনিয়াকে৷ তিনি ধর্মসূত্রে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের । আশির দশকে রাজীব গান্ধী তার স্ত্রী সোনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে নেপাল সফরে গিয়েছিলেন । সেই সময় তারা পশুপতিনাথ মন্দিরে যান । কিন্তু দু’জনেই অহিন্দু হওয়ার কারনে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি । রাজীব গান্ধী তৎকালীন রাজা বিক্রম সিংকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধও করেছিলেন, কিন্তু রাজা বিশ্বাসের বিষয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা বলে রাজীবের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন ৷ বলা হয় যে, ক্ষুব্ধ রাজীব ১৯৮৯-৯০ সালে নেপালের উপর আর্থিক অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে নেপালের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছিল । পুরো নেপাল অনাহারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়… দুধ, পেট্রোলের ঘাটতি দেখা দেয় ।
এদিকে দেং-এর অধীনে এক দশকের রূপান্তরমূলক সংস্কারের মধ্য দিয়ে এবং ১৯৮৯ সালের তিয়ানানমেন স্কোয়ার বিক্ষোভ ও গণহত্যা কাটিয়ে উঠে আগের দশকে ২.৩ শতাংশের তুলনায় দ্বিগুণ অঙ্কের প্রবৃদ্ধি নিবন্ধন করা শুরু করেছে চীন । চীন তার আশেপাশের অঞ্চলকে প্রভাবিত করার জন্য তার নতুন-আবিষ্কৃত অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করতে শুরু করেছিল । সেই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের সূযোগ কাজে লাগিয়ে নেপালকে নিজেদের কাছে টানার প্রচেষ্টা শুরু করে চীন এবং সফলও হয় । ক্রমে চীনের সাথে নেপালের ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে। ভারতে আস্থা কমিয়ে দেয় নেপাল । যার ফলে আজও নেপালের সাথে ভারতের সম্পর্কে আগের মত আর স্বাভাবিক হয়নি । যদিও রাজীব গান্ধীকে আড়াল করতে তখন সরকারিভাবে বলা হয়েছিল যে বাণিজ্য,ট্রানজিট এবং চীন থেকে অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়ে নেপালের কঠোর অবস্থানের কারণে ভারত সরকার নেপালের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপাতে বাধ্য হয়েছিল । কিন্তু এটা ছিল সম্পূর্ণ একটা ভিত্তিহীন অভিযোগ ।
তবে রাজীব গান্ধীর এই সিদ্ধান্ত শুধু নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তিক্তই করেনি, বরঞ্চ হিন্দু রাষ্ট্র নেপালের মধ্যেও আমূল পরিবর্তন এনে দেয় । নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নেপালে বেশ কিছু ঘরোয়া হতাশা ছিল যেমন দারিদ্র্য, দমনমূলক নীতির প্রতি অসন্তোষ এবং রাজতন্ত্রের অধীনে দুর্নীতি যা সেদেশের মাওবাদী আন্দোলনকে উস্কে দিয়েছিল । ২০০১ সালের পয়লা জুন রাজকীয় গণহত্যার পর প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবাকে বরখাস্ত করে, সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন রাজা জ্ঞানেন্দ্র । এই পদক্ষেপ মাওবাদী বিদ্রোহীদের শক্তিশালী করে এবং নেপালের গৃহযুদ্ধকে আরও তীব্র করে তোলে।
নেপাল মাওবাদী বিদ্রোহের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অস্ত্রের জন্য চীনের দিকে তাকিয়েছিল, এর আগে ভারত ছিল সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ । এদিকে আমেরিকা এবং ব্রিটেন রাজা জ্ঞানেন্দ্রের ক্ষমতা দখলের পর সামরিক সহায়তা স্থগিত করেছিল। এটি চীনাদের জন্য একটি বড় দরজা খুলে দিয়েছিল, ঠিক যেমনটি শ্রীলঙ্কায় হয়েছিল এলটিটিই-এর সাথে লড়াইয়ের সময় ।
নেপালের ২০০৬ জন আন্দোলন (জনগণের আন্দোলন)-২ -এর পর চীনপন্থী সিপিএন(এম) নেতৃত্বাধীন জোট নেপালের ক্ষমতায় আসে এবং রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় । ২০০৬ সালের ২৯ মে, অন্তর্বর্তী সরকার নেপালকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে । নেপালের চীনপন্থী সরকার ২০০৬ সাল থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে প্রায় সমস্ত বিষয়ে চীনা হস্তক্ষেপের শক্তিশালী ছাপ রয়েছে, যার মধ্যে নেপালি কংগ্রেস ভারতের বিরুদ্ধে বৈরী অবস্থান নেওয়া, এমনকি নেপালি জমি দখলের অভিযোগ এনে নয়াদিল্লিকে চাপে ফেলা, বিতর্কিত কালাপানি-লিম্পিয়াধুরা দেখানো মানচিত্র জারি করা করা, লিপুলেখ অঞ্চল নেপালের অংশ, এবং এই পরিবর্তনগুলি তাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা প্রভৃতি। এছাড়া পাকিস্তান আইএসআই ভারতে জাল মুদ্রা, অস্ত্র ও মাদক পাচারের জন্য ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে বাংলাদেশের মতো নেপালকেও ব্যবহার করতে শুরু করে । ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম) শীর্ষ অপারেটিভ ইয়াসিন ভাটকল এবং লস্কর-ই-তৈয়বা অপারেটিভ আব্দুল করিম টুন্ডাকে গ্রেপ্তার করা হয় ভারত-নেপাল সীমান্ত থেকে৷ কিন্তু ভারতের সাথে নেপালের প্রত্যর্পণ চুক্তির অভাবে সমস্যার মুখে পড়তে হয় নয়াদিল্লিকে ৷
তবে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্র থেকে শুরু করে রোটি-বেটি ‘ (খাদ্য ও বিবাহ) সম্পর্ক, নেপাল ভারতের উপর তার অর্থনৈতিক নির্ভরতা বোঝে ।নেপালি মুদ্রা ভারতের সাথে বিনিময় করা হয়,নেপাল বাণিজ্যের জন্য ভারতীয় বন্দরের উপর নির্ভর করে এবং ৬ মিলিয়ন নেপালি ভারতে কাজ করে। ৩২,০০০-এরও বেশি গোর্খা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করে এবং উভয় দেশের সেনাপ্রধান একে অপরের সেনাবাহিনীতে সম্মানসূচক পদে অধিষ্ঠিত । তবুও রাজীব গান্ধীর ব্যক্তিগত ইগোর সেই অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারনে ভারত-নেপাল সম্পর্ক আজও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসেনি ।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নেপালের অভ্যন্তরে খ্রিস্টান মিশনারিদের উপস্থিতি, মুসলিম অনুপ্রবেশ সমস্যার পাল্টা হিসেবে নেপালে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বেড়েছে । গত বছরের আগস্টে,নেপালের প্রাক্তন সেনা জেনারেল কাটাওয়ালের নেতৃত্বে একদল লোক নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে পুনরুদ্ধারের জন্য একটি অভিযান শুরু করে। হিন্দু জাতির দাবি রাজতন্ত্র ফেরানোর দাবির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এর কারণ হল রাজতন্ত্র হিন্দুধর্মের সাথে মিশে গেছে এবং রাজাকে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর অবতার হিসেবে গণ্য করা হয় । নেপালিরা তাদের নিজস্ব পরিচয় জাহির করতে পছন্দ করে, প্রায়শই ভারতকে এনিয়ে কটাক্ষ করে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে, সীমান্তের উভয় পাশে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা একটি সাধারণ কারণ খুঁজে পেয়েছে।।