প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৪ জুন : কোভিড আক্রান্তদের প্রাণে বাচানোর জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিন রাত এক করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা । নিজে কোভিড যুদ্ধে নিজে সামিল হতে না পারলেও ’প্রথম সারির ’ সেইসব কোভিড যোদ্ধাদের জন্য বিশেষ কিছু একটা করার ব্যাপারে মনস্থির করে বসে দ্বাদশ শ্রেনীর ছাত্র দেবর্ষি দে। সেই অনুযায়ী নিজের বিজ্ঞান ভাবনা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেবর্ষি তৈরি করে ফেলেছে “ইউনিভার্সাল মাস্ক এয়ার সাপ্লায়ার“।পিপিই কিট পরিহিত প্রথম সারির করোনা যোদ্ধাদের মুখে থাকা তাঁর তৈরি ’মাস্ক’ ’ফ্রেশ অক্সিজেন’ সরবরাহ করবে । পাশাপাশি শ্বাস কষ্টের রোগীরা ’নেবুলাইজেশনের’ সহায়তাও তাঁর আবিস্কৃত মাস্কের মাধ্যমে পাবেন বলে দেবর্ষি দাবি করেছে ।খুব শুঘ্রই কোভিড সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা ।তার প্রাক্কালে এক খুদে বিজ্ঞানির তৈরি সামান্য মূল্যের এমন ’অভিনব মাস্ক’ প্রশাসন ও চিকিৎসক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে।
মেধাবী ছাত্র দেবর্ষি দে-র বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থানার প্রত্যন্ত গ্রাম বেত্রাগড়ে । সে জামালপুরের সেলিমাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের
দ্বাদশ শ্রেনীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। দেবর্ষি জানিয়েছে, দুই ধরণের ‘ইউনিভার্সাল ’মাস্ক এয়ার সাপ্লায়ার’ সে তৈরি করেছে । তার মধ্যে একটি প্রথম সারির কোভিড যোদ্ধা অর্থাৎ ডাক্তার ও নার্সদের ব্যবহারের জন্যে । আর একটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্যে ।
দেবার্ষি আরও জানিয়েছে,“দুটি ’মাস্ক এয়ার সাপ্লায়ার সে একই প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে। তবে ডাক্তার ও নার্সদের জন্যে তাঁর তৈরি ’মাস্ক এয়ার সাপ্লায়ারটি’ উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন । সেই কারনে সাধারণ মানুদের ব্যবহারের জন্যে তাঁর তৈরি করা ’মাস্ক এয়ার সাপ্লায়ারটি’ আকারে একটু ছোট ।আর ডাক্তার ও নার্সদের জন্যে তৈরি মাস্ক এয়ার সাপ্লায়ারটি আকারে একটু বড়। মুলত ১২ ভোল্ট ডিসি রি-চার্জবল লিথিয়াম- আয়ন ব্যাটারি,বাজার থেকে কেনা একটি ’টিপি ৪০৫৬’ এবং একটি ’এক্স এল ৬০০৯’ সার্কিট বোর্ড এবং নিজের তৈরি করা অপর একটি সার্কিট বোর্ড ’ইউনিভার্সাল মাস্ক এয়ার সাপ্লায়ার’ এর ভিভাইসটিতে রয়েছে বলে দেবর্ষি জানিয়েছে ।
নিজের তৈরি করা ডিভাইসের ব্যখ্যা দিতে গিয়ে দেবর্ষি জানিয়েছে ,সাধারণ মানুষের জন্য তৈরি করা তাঁর ’মাস্ক এয়ার সাপ্লায়ার এর ডিভাইসটিতে ২ টি ‘এয়ার সাকার’ রয়েছে । আর ডাক্তার ও নার্সদের ব্যবহারের জন্যে তৈরি করা ডিভাইসটিতে রয়েছে ৫ টি ‘এয়ার সাকার’ । প্রতিটি ’এয়ার সাকারের’ মধ্যে রয়েছে ৬ টি ০.১-০.৩ মাইক্রোনের ফিল্টার । যা বাতাসকে ১০০ শতাংশ বিশুদ্ধ করে পাইপ লাইনের মধ্যমে মাস্কের ভিতরে পাঠিয়ে দেয় । ছোট ডিভাইস টিতে থাকা সুইচ দ্বারাই ডিভাইসটি কন্ট্রোল করা যাবে । আর বড় ডিভাইসটি তার (wire) দ্বারা যুক্ত রিমোটের মাধ্যমে কন্ট্রোল করতে হয় । ছোট ডিভাইসটির ওজন ২০২ গ্রাম আর বড় ডিভাইসটির ওজন ৪০৫ গ্রাম । যা সহজেই ব্যবহার যোগ্য । সরু পাইপের ইনপুট লাইন ডিভাইসের সঙ্গে যুক্ত থাকবে আর আউটপুট পাইপ লাইন মাস্কের সঙ্গে যুক্ত থাকবে । এছাড়াও নিমুলাইজার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ১৫ এমএল এর নিমুলাইজার চেম্বারটি ’ইনপুট’ পাইপ লাইন ডিভাইসের সাথে এবং চেম্বারের ’আউটপুট’ পাইপ লাইনটি মাস্কের সাথে যুক্ত করতে হবে । শ্বাস কষ্টের রোগীরা এক্ষেত্রে উপকার পাবেন। ’ডাক্তার ও নার্সদের ব্যবহারের জন্য তৈরি করা বড় ডিভাইসের ’ইউনিভার্সাল মাস্ক এয়ার সাপ্লায়ারটি’ তৈরি করতে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ।আর একই প্রযুক্তিতে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্যে তৈরি করা ছোট ডিভাইসের মাস্ক এয়ার সাপ্লায়ারটি তৈরী করতে সর্বোচ্চ ৩০০- ৩৫০ টাকা খরচ পড়েছে বলে খুদে বিজ্ঞানি দেবর্ষি দাবি করেছে’ ।
দেবর্ষির বাবা ব্রজেন দে হাওড়ার লিলুয়ার এমসিকেবি ইনস্টিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কেমিস্ট্রির প্রফেসার। মা হীরা দে সাধারণ গৃহবধূ।দেবর্ষির দিদি দেবর্পিতা কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে এমসিকেবি ইনস্টিটিউটে তৃতীয় বর্ষে পাঠরত।ব্রজেন বাবু ও হীরাদেবী বৃহস্পতিবার বলেন,’ছোট বয়স থেকেই বিজ্ঞান ভিত্তিক কারিগরি বিষয় নিয়ে দেবর্ষির আগ্রহ আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। ইলেকট্রনিক্স খেলনা বা অন্য যা কিছু সে হাতের কাছে পেত তার সবটা খুলে ভিতরে কিকি পার্টস আছে , সেই পার্টস গুলি কি ভাবে কাজ করছে তা বোঝার চেষ্টা করতো দেবর্ষি। এইসব ছাড়াও ফেলে দেওয়া ইলেকট্রনিক্সের সরঞ্জাম থেকে নতুন কিছু তৈরি করা যায় কিনা তারও প্রচেষ্টা ছেলে দেবর্ষি চালাতো ।ব্রজেন বাবু বলেন , এখন স্কুল বন্ধ রয়েছে। বাড়িতে বসেই নিজের বিজ্ঞান ভাবনা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে কাছে লাগিয়ে তাঁর ছেলে দেবর্ষি প্রথম সারির করোনা যোদ্ধা ডাক্তার ও নার্স এবং একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের জন্যে ’ইউনিভার্সাল মাস্ক এয়ার সাপ্লায়ার’ তৈরি করে ফেলেছে জেনে তিনি গর্বিত বোধ করছেন । দেশ ও দেশের মানুষের কল্যানে লাগবে এমন আরও অনেক কিছু দেবর্ষি আবিস্কার করুক এমটাই ইচ্ছার কথা মা হীরাদেবী শুনিয়েছেন। জামালপুর ব্লক হাসপাতালের বিএমওএইচ চিকিৎসক ঋত্বিক ঘোষ জানিয়েছেন ,পিপিই কিট পরিহিত হয়ে কাজ করা ডাক্তার ও নার্সদের ক্ষেত্রে দেবর্ষির আবিস্কৃত ’মাস্ক’ সহায়ক হতে পারে বলেই তাঁর মনে হয়েছে ।
অন্যদিকে ব্লকের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার
জানিয়েছেন, “দেবর্ষির আবিস্কৃত ’মাস্কটি’ অভূতপূর্ব লাগায় তিনি বিষয়টি সম্বন্ধে বিএমওএইচ কে জানান । এমন ’মাস্ক’ প্রথম সারির কোভিড যোদ্ধারের কাজের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা নেবে বলেই তাঁর মনে হয়েছে। সার্টিফিকেশনের জন্যে বিএমওএইচ মাস্কের বিষয়টি নিয়ে জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন । সার্টিফিকেশন পাওয়া গেলে সরকারী ভাবে দেবর্ষির আবিস্কৃত ’মাস্ক’ ব্যবহার করা যাবে বলে বিডিও জানিয়েছেন ।।