দিনটা ছিল ২০১৯ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি। ঘুম ঘুম চোখে কুয়াশামোড়া এক ভোরে কয়েকজন সহকর্মীকে সঙ্গী করে বেড়িয়ে পড়লাম অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে। সঙ্গী সেই চিরকালের প্রিয় নীল সুটকেস। শীতের ভোরে একটু বেগ পেতে হল উবের পেতে। দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখি আমার বন্ধুরা আগেই পৌঁছে গেছে।দেরী না করে ভিতরে ঢুকে গেলাম। মধ্যবিত্ত ঘরের একটি মেয়ের প্রথম উড়ানযাত্রা। তাই বুকের ভিতর একটা চাপা উত্তেজনা তো ছিলই। সমস্ত নিয়ম কানুন পালন করে অবশেষে চড়ে বসলাম উড়োজাহাজে। হাতে মুঠোফোনের ক্যামেরা রেডি করে বসে পড়লাম জানালার ধারে ।
যথাসময় নীল আকাশের সাদা মেঘ ফুঁড়ে উড়োজাহাজ পাড়ি দিল শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে। নীলাভ আকাশে শুধুই মেঘের রাজত্ব। মনে হচ্ছে যেন স্বর্গের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আমি মানবী ভেসে বেড়াচ্ছি। এ যেন এক অন্য জগৎ, অন্য রকম অনুভূতি। মাঝে মাঝে মেঘেদের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি, ঘর, জমি, রাস্তা, নদী, গাছপালা। ঠিক যেন ছোটোবেলার খেলনা-বাটি। মেঘেরা আড়াল হলেই সূর্যদেব তার আলোর ছটায় ভরিয়ে দিচ্ছে চারিদিক। প্রকৃতির এই রূপ উপভোগ করতে করতে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বাগডোগরা বিমানবন্দরে।
দেরী না করে উঠে পড়লাম অটোতে। প্রায় ঘন্টাখানেক পথ চলার পর পৌঁছালাম আগে থেকে বুকিং করে রাখা আমাদের হোটেলে। অটোর ভাড়া মিটিয়ে আমরা পঞ্চপাণ্ডব ঢুকলাম হোটেলে। হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে ঘরের চাবি নিয়ে আমরা যে যার ঘরে ঢুকে গেলাম। খুব বড়ো না হলেও ঘরদুটি বেশ ছিমছাম, সাজানো গোছানো। মখমল বিছানার ধবধবে সাদা চাদরের ওপর গা এলিয়ে দিতেই চোখে নেমে এল ঘুম, চলে গেলাম স্বপ্নের দেশে, মেঘের ভেলায় চড়ে।
যখন দিবানিদ্রা ভঙ্গ হল ঘড়ি জানান দিচ্ছে দুপুর ১টা। চটজলদি স্নান সেরে বেড়িয়ে গেলাম মধ্যাহ্নভোজনের উদ্দেশ্যে। ভোজনরসিক বাঙালি ঠিক মাছভাতের সন্ধান করে নিলাম। খাওয়ার শেষে সামান্য বিশ্রামের পর প্রকৃতিকে আরও কাছ থেকে দেখার উদ্দেশ্যে একটি অটো ধরে আমরা পাঁচ বন্ধু পাড়ি দিলাম করোনেশন ব্রিজের উদ্দেশ্যে। সেবক রোডে যখন পৌঁছালাম তখন দেখি প্রকৃতি তার রূপ বদলাতে শুরু করেছে। হাতের ঘড়িতে তখন বিকেল ৪ টে। নামলাম বাঘপুলে। কিন্তু এ কি! নিকষ কালো অন্ধকার যেন গ্রাস করেছে গোটা প্রকৃতিকে। তিস্তার উচ্ছ্বলতা, আকাশে মেঘের ঘনঘটা, ধোঁয়াশায় চারিদিক অস্পষ্ট। শুনেছি পাহাড়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। কিন্তু সেই দৃশ্য অবলোকনের সৌভাগ্য যে হবে তা বুঝিনি। কয়েকটা প্রাকৃতিক শোভা, দৃশ্য ও নিজস্বী ক্যামেরাবন্দী করেছি।
হঠাৎ শুরু হল মেঘের গুরু গুরু শব্দ। দূরে পাহাড়ের মাথায় দেখতে পেলাম আলোর ছটা। বিদ্যুতের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যেতে লাগল। তার সাথে যোগ দিল বজ্রপাতের হৃদয়বিদারক আওয়াজ। ওদিকে হাওয়ার গতিবেগ বেড়েই চলেছে। তিস্তা নদীও গর্জন করতে শুরু করেছে। হাওয়ার তালে তালে স্রোতও বেড়ে চলেছে। পাহাড়ের তর্জন, স্রোতের গর্জন, আকাশের চোখ রাঙানি- সবমিলিয়ে প্রকৃতি যেন এক বীভৎস রুদ্ররূপ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে যেন এক রাক্ষসী তার এলোচুল মেলে জাপটে ধরেছে প্রকৃতিকে। এরইমধ্যে শুরু হল টিপ টিপ বৃষ্টি। আমরা সবাই পা বাড়ালাম ফেরার পথে।
আমাদের গতি যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার দ্বিগুণ হারে বেড়ে চলেছে হাওয়ার বেগ ও বৃষ্টির গতি। বড় বড় জলের ফোঁটাগুলো যেন তীরের মতো এসে বিঁধছে শরীরে। এবার পাহাড়ি রাস্তায় ছুটতে শুরু করলাম আমরা। পাহাড়ের বৃষ্টি সমতলের থেকে অনেক আলাদা এবং ভয়ংকর। শুরু হলে সহজে থামেনা। কালো চাদরে ঢেকে গেল প্রকৃতি। আমরা আশ্রয় নিলাম জাগ্রত সেবকেশ্বরী কালী মন্দির চত্বরে। পুজো দিয়ে মাকে প্রার্থনা জানাতে লাগলাম এই দুর্যোগ থেকে মুক্তির জন্য। হাতঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা ছুঁই ছুঁই, তবুও বৃষ্টি কমার নাম নেই। এদিকে তিস্তার জলও ফুঁসছে। এখানে আসার সময় এক সহযাত্রী আমাদের বলেছিলেন যে টাউনে ফেরার শেষ বাস মেলে সাড়ে পাঁচটায়, তারপর আর কোনো বাস থাকেনা। তার উপর বৃষ্টি হলে তো আরও সমস্যা। শীতের বৃষ্টিভেজা জলের কাঁপুনিকে ছাপিয়ে গেল আমাদের বুকের ধুকপুকুনি। দুরুদুরু বুকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছি বৃষ্টিভেজা, অন্ধকার রাস্তার দিকে। “আর বোধহয় বাড়ি ফেরা হল না। এই পঞ্চপাণ্ডব আজ হারিয়ে যাবে পাহাড়ের কোলে”- এই ভাবনায় বুকের ভিতরটা অবিরত কম্পমান।
জনমানবহীন রাস্তায় হঠাৎ দূর থেকে দেখা গেল এক আলোর রেখা। ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম আমরা। একমুহূর্তও দেরী না করে ঝটপট উঠে পড়লাম বাসে। বাস রওনা দিল শহর অভিমুখে। পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রুদ্ধশ্বাস গতিতে ছুটে চলেছে বাসের চাকা। একফুট দূরত্বও এখানে দৃশ্যমান নয়। অনেক অলৌকিক ও ভৌতিক অভিজ্ঞতার জন্য সন্ধ্যে রাতে এই রাস্তায় বিশেষ লোকের আনাগোনা নেই। লোক তো দূর, কোনো প্রাণীরও দেখা মেলেনা এখানে। জনমনুষ্যহীন এই অন্ধকার রাস্তা পার করে বাস উঠল আলোঝলমলে রাস্তায়। একটু আগেই নির্জন, আর এখন কোলাহলমুখর, পুরোপুরি বৈপরীত্য। এসে নামলাম পি.সি. মিত্তল বাস টার্মিনাসের সামনে।
তখনও অঝোরধারায় বর্ষণ অব্যাহত- অবিশ্রান্ত, ক্লান্তহীন, দিবা নিশি ঝরেই চলে। রাস্তাঘাট জলে ভরে গেছে তাই যানবাহনের সংখ্যাও রাস্তার কম। আবারও আমরা অপেক্ষমান, তবে এবার জনবহুল রাস্তায়। এরকম অপেক্ষারত অবস্থায় কতক্ষণ কেটেছে জানিনা। হঠাৎ ভাগ্যদেবীর কৃপায় একটি অটোর দেখা মিলল। উঠে পড়লাম সদলবলে। রাত নটায় পৌঁছালাম হোটেলের সামনে।
এখানেও বৃষ্টির জন্য রাস্তা নির্জন ও অন্ধকার। কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেলাম নিকটস্থ একটি চায়ের দোকানে । গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে শরীরে ও প্রাণে হারানো শক্তি ও মনোবল ফিরে পেলাম। তারপর যে যার হোটেলের রুমে ঢুকে ভেজা জামা কাপড় পরিবর্তন করে নিকটবর্তী একটি ধাবায় নৈশভোজ করতে গেলাম। নৈশভোজ সেরে হোটেলে ঢুকে ক্লান্ত শরীরে সবাই সবাইকে বিদায় জানিয়ে সে যার কক্ষে ঢুকে পড়লাম।
নাহ! আজ আর গল্প করার মতো শরীরে বল নেই, তাই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম সফেন সাদা বিছানায়। আজও নৈসর্গিক শোভা অবলোকন করেছি। কিন্তু অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি সবই একটু অন্যরকম, ভিন্নস্বাদের, রোমহর্ষকও বটে। খুব শীঘ্রই দু’চোখ জুড়ে নেমে এল ঘুম। ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি এসে হাত ধরে নিয়ে গেল আমায় সেই দূরপ্রান্তে এক ঘুমের দেশে ।।