বহুমুখি প্রতিভাবার অধিকারী অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা অভিনেত্রী স্নেহালতা রেড্ডি ভিন্নমতের নির্ভীক কণ্ঠস্বর ছিলেন । গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং অহিংস প্রতিরোধের প্রতি তার নিঃশর্ত অঙ্গীকারের জন্য তিনি সম্মানিত । কিন্তু এমন একজন সম্ভাবনাময় শিল্পিকে ১৯৭৬ সালের ২ মে ডিনামাইট মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। স্নেহলতার বিরুদ্ধে আইপিসির ১২০,১২০এ প্রভৃতি ধারায় অভিযোগ আনা হয় । যদিও শেষ পর্যন্ত এসব অভিযোগের কোনোটিই প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু এমআইএসএ (মেইনটেন্যান্স অফ ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট)-এর অধীনে স্নেহলতার কারাবাস অব্যাহত ছিল। এমআইএসএ হল সেই আইন যার অধীনে জরুরি অবস্থার সময় সর্বাধিক গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এর আওতায় তাঁকে বেঙ্গালুরু জেলে বন্দী করা হয়েছিল এবং জেলের ভিতরে চুড়ান্ত অমানবিকতার শিকার হতে হয়েছিল ।
সরু এক ফালি ঘর,শৌচকর্মের জন্য ঘরে ছোট্ট একটা গর্ত, সেখানেই রাখা হয়েছিল বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত স্নেহলতাকে । স্নেহলতা হাঁপানির রোগী ছিলেন, তা সত্ত্বেও তাকে জেলের মধ্যে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছিল । জেলে তাকে নিয়মিত চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। স্নেহলতা নিজেই এসব কথা মানবাধিকার কর্মীদের সামনে বলেছিলেন । একটি ছোট ডায়েরিতে স্নেহলতা লিখেছিলেন,’একজন মহিলা প্রবেশ করার সাথে সাথেই তাকে অন্য সবার সামনে নগ্ন করা হয়। যখন একজন ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া হয়, তখন তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয়। মানবদেহেরও কি অবমাননা করা উচিত? এসব বিকৃত পথের জন্য দায়ী কে? মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কি? জীবনের মূল্যবোধকে আরও উন্নত করা কি আমাদের লক্ষ্য নয় ? একজন ব্যক্তির লক্ষ্য যাই হোক না কেন, তার উচিত মানবতাকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা।’
নিদারুন কষ্টে মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠতেন স্নেহালতা রেড্ডি । সেই চিৎকার শুনেছেন পাশের দুই ঘরে থাকা অটলবিহারী বাজপায়ী ও লালকৃষ্ণ আদবানিরা । দীর্ঘ ৮ মাস নির্যাতনের পর অবশেষে তাকে যখন মুক্তি দেওয়া হয় তখন তার আশঙ্কাজনক অবস্থা । ফলশ্রুতিতে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার মাত্র ৫ দিনের মাথায় মাত্র ৪৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন স্নেহলতাদেবী । অথচ তাঁর কোনো দোষই ছিল না । তাঁর অপরাধ বলতে ছিল শুধু কংগ্রেসের বিষ নজরে থাকা একজন রাজনীতিকের সাথে বন্ধুত্ব করা । আর সেই নেতা হলেন জর্জ ফার্নান্ডেস, যাকে পুলিশ জরুরী অবস্থার সময় ধরার চেষ্টা করেছিল ।
স্নেহলতা রেড্ডি (১৯৩২-১৯৭৭) অন্ধ্র প্রদেশে এক ভারতীয় খ্রিস্টান ধর্মান্তরিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যখন তিনি বড় হয়েছিলেন, তিনি একজন অভিনেতা, লেখক, প্রযোজক এবং পরিচালক হিসাবে থিয়েটারে তার কর্মজীবন গ্রহণ করেছিলেন। চেন্নাইয়ের থিয়েটার আন্দোলনে তিনি মূল্যবান অবদান রেখেছিলেন। তারও নাচের প্রতি ঝোঁক ছিল এবং শ্রী কিত্তপ্পা পিল্লাইয়ের অধীনে একজন দক্ষ ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠেন।
পরবর্তী জীবনে, তিনি কবি, গণিতবিদ এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক পাত্তাভাই রামা রেড্ডিকে বিয়ে করেন। তার স্বামীর সাথে, তিনি ভারতে জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে ওঠেন। আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা এবং সমাজতান্ত্রিক নেতাদের সাথে তার বন্ধুত্বের কারণে, তিনি কংগ্রেসের বিষ নজরে পড়েন ।
জীবদ্দশায়, স্নেহলতা রেড্ডি কন্নড় সিনেমা, কন্নড় থিয়েটার, তেলেগু সিনেমা এবং তেলেগু থিয়েটারের একজন সুপরিচিত মুখ ছিলেন। তিনি চেন্নাইয়ের প্রাচীনতম ইংরেজি ভাষার থিয়েটার গ্রুপ দ্য মাদ্রাজ প্লেয়ার্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন ।স্নেহলতা রেড্ডি এমন একজন শিল্পি ছিলেন যিনি তার ভারতীয়ত্বকে জাহির করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং তাদের ঔপনিবেশিক শাসনকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন, এই কারণেই তিনি তার ইংরেজি নাম পরিত্যাগ করে ভারতীয় নামে ফিরে আসেন। তিনি এবং তার স্বামী কট্টর সমাজতন্ত্রী ছিলেন এবং আর্থ-সামাজিক মতাদর্শী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ডঃ রামমনোহর লোহিয়ার আদর্শ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি তার স্বামীর সাথে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক ১৯৭৫ জারি করা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে তীব্রভাবে লড়াই করেছিলেন। তৎকালীন অনেক বুদ্ধিজীবীর মত, তারা জরুরী অবস্থাকে অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক হিসাবে দেখেছিলেন । এটি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত হয়, যেখানে ব্যক্তিদের ভিন্নমতের অধিকার তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং ভিন্নমতের ব্যক্তিদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হয়েছিল। স্নেহলতা রেড্ডিকে ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার প্রথম শহীদদের একজন হিসাবে স্মরণ করা হয় ।।