এইদিন ওয়েবডেস্ক,তেহেরান,১৪ জুন : কট্টর ইসলামি রাষ্ট্র ইরানে চলছে শরিয়া শাসন । এই শাসনের আওতায় যত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তার সিংহভাগই মহিলাদের উপর । হিজাব বিধি ঠিকমত না মানায় ২২ বছরের কুর্দি তরুনী মাহাসা আমিনিকে নির্মমভাবে হত্যার পড় তোলপাড় শুরু হলে ইরানের ধর্মগুরু ও শাসকের পাশবিক অত্যাচারের সত্যতা বিশ্বের নজরে আসে । যদিও তার অনেক আগে থেকেই অবর্ণনীয় নিপীড়নের মুখোমুখি হয়ে আসছিল ইরানি মহিলারা । মাহাসা আমিনি নিজের জীবন দিয়ে ইরানের নারীদের উপর ঘটে চলা অত্যাচারের কাহিনী বিশ্বের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন দেশের মানুষদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন ।
২০০৪ সালে ১৬ বছরের কিশোরী আতেফেহ সাহালেহ(Atefeh Sahaaleh)-এর উপর যে নৃশংসতা ঘটেছিল তাকে পাশবিক আখ্যা দিলে পশুদের অপমান করা হয় । বাপ-মা হারা ওই ছোট্ট মেয়েটি তিন বছর ধরে ধর্ষণের শিকার হচ্ছিল হয়েছিল ৫১ বছর বয়স্ক আলি দারাবি (Ali Darabi) নামে এক নরপশুর দ্বারা । উলটে মেয়েটিকে অসতী আখ্যা দিয়ে জেলে পাঠানো হয় । কারাগারের মধ্যেও ছোট্টো মেয়েটির উপর চলে অবর্ণনীয় যৌন নির্যাতন । সেই অত্যাচারে নিজের দু’পায়ে হাঁটার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে মেয়েটি ।পাকিস্তানি বংশভূত নাস্তিক ইমতিয়াজ মেহেমুদ লিখেছেন,শিয়া শাসিত ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু আয়াতুল্লাহ খোমেনির বাণী হল, ‘কুমারী মহিলা বন্দীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে ধর্ষণ করা উচিত যাতে তারা স্বর্গে যেতে না পারে’ ।
এদিকে যৌন নিপিড়নকারীকে শাস্তি না দিয়ে যখন নির্যাতিতাকে দোষী সব্যস্ত করার চেষ্টা চলছিল তখন এজলাসের মধ্যেই ভন্ড সমাজ ও বিচার ব্যবস্থার উপর তীব্র ঘৃণা থেকে নিজের জিহাব ও জুতো খুলে বিচারকের দিকে ছুড়ে মেরেছিল মেয়েটি । পরিণামে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় । প্রকাশ্য রাস্তায় ক্রেনের সাহায্যে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় মেয়েটিকে ।
ইমতিয়াজ মেহেমুদ মেয়েটির একটা ছবি পোস্ট করে টুইট করেছেন,এই হল আতেফেহ সাহালেহ(Atefeh Sahaaleh) একজন ষোল বছর বয়সী কুর্দি/ইরানি মেয়ে, যে তিন বছর ধরে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, তাকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, কারাগারে এমন গুরুতরভাবে যৌন নিপিড়ন করা হয়েছিল যে সে হাঁটতে পারত না ৷ সে আদালতে তার হিজাব খুলে ফেলে এবং বিচারকের দিকে তার জুতা ছুড়ে দেয় বুঝতে পেরে সে মামলাটি হেরে যাচ্ছে, এবং সেই কারণে, বিচারক নিজেই তার গলায় ফাঁস দেওয়ার জন্য জোর দিয়েছিলেন ।
ইরানের মাশহাদে জন্মগ্রহণকারী আতেফেহ সাহালেহের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। এর কিছুক্ষণ পর তার ছোট ভাই নদীতে ডুবে মারা যায় বলে জানা গেছে। তার বাবা একজন মাদকাসক্ত হয়ে ওঠেন এবং তাকে তার অশীতিপর দাদু-ঠাকুমার যত্ন নিতে বাধ্য করা হয়। তাদের চাহিদার প্রতি তার মনোযোগ থাকা সত্ত্বেও, তারা তাকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছে বলে জানা গেছে। আতেফেহ সাহালেহকে “প্রাণবন্ত এবং বুদ্ধিমান মেয়ে” হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল।
৫১ বছর বয়স্ক আলি দারাবির (Ali Darabi) দ্বারা বারবার ধর্ষণের পর আতেফেহকে সতীত্ব নষ্টের অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। আলি দারাবির ছিল প্রাক্তন বিপ্লবী গার্ড ছিল,পরে সে ট্যাক্সি চালাত । দারাবি সেই সময় একজন বিবাহিত পুরুষ ছিল যার বেশ কয়েকটি সন্তানও ছিল। আতেফেহকে তার পরিবারের অজান্তেই দারাবি তিন বছর ধরে ধর্ষণ করেছিল । কারাগারে থাকাকালীন আতেফেহকে কারারক্ষীদের দ্বারা আরও নির্যাতন ও যৌন শোষণের শিকার হতে হয় । মেয়েটি ঘটনার কথা তার ঠাকুমাকে বলেছিলে, যিনি সচক্ষে দেখেও আসেন । পরে মেয়েটির ঠাকুমা বলেছিলেন, ব্যথার কারণে তার নাতনি কেবল দুই হাতে ভর দিয়ে ঘোরাফেরা করত ।
তার মামলার বিচারক ছিল হাজী রেজাই(Haji Rezai) । আতেফাহ যখন বুঝতে পেরেছিল যে সে তার মামলা হেরে যাচ্ছে, তখন সে তার হিজাব খুলে ফেলে, এটি আদালতের চরম অবমাননা হিসাবে দেখা একটি কাজ । মেয়েটি এবং যুক্তি দিয়েছিল যে আলি দারাবির শাস্তি হওয়া উচিত, তার নয়। এমনকি সে তার জুতা খুলে বিচারকের দিকে ছুড়ে মারে। সেই অপরাধে বিচারক রেজাই পরে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, সুপ্রিম কোর্টে আপিলের উপস্থাপিত নথিতে মেয়েটির বয়স ২২ বছর হিসাবে দাবি করা হয়েছে, কিন্তু তার জন্ম ও মৃত্যু শংসাপত্রে বলা হয়েছে যে তার বয়স তখন ১৬ বছর । অনেক দেরি হওয়ার আগে তার বয়সের বিষয়টি যথাযথভাবে নজরে আনা হয়নি। আতেফেহ সাহালেহকে ২০০৪ সালের ১৫ আগস্ট, নেকাতে একটি ক্রেন থেকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং অন্যান্য সংস্থা তার মৃত্যুদণ্ডকে মানবতা এবং বিশ্বের শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে।
এরপর তিনি লিখেছেন,’সম্প্রতি আরেক ইরানী মহিলাকে তার স্বামীকে ছুরিকাঘাত করার জন্য ফাঁসি দেওয়া হয়েছে । কারণ মহিলার স্বামী তাকে এবং তার সন্তানদের প্রতি অশালীন আচরণ করেছিল। কিন্তু ফাঁসির আগে তার হৃদরোগে মৃত্যু হয় । কিন্তু মারা যাওয়ার পরেও মহিলার মৃতদেহ ফাঁসিতে ঝোলানো হয় । তীব্র ক্ষোভের সাথে ইমতিয়াজ মেহেমুদ লিখেছেন, ‘হ্যাঁ, এটা হল অশুভ ও নিষ্ঠুরতার মাত্রা যা ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র। ইরানে একজন ব্যক্তি তার নাবালিকা মেয়েকে হত্যা করেছিল । আর যাতে সে তাদের স্বর্গের সংস্করণে পৌঁছাতে না পারে সেই কারনে হত্যার আগে মেয়েকে যৌন নির্যাতন করেছিল তার বাবা । তিনি আরও লিখেছেন,’ইরানে সন্তান পিতার সম্পত্তি; যদি কোনো কারনে বাবার নজরে সন্তান “খারাপ” প্রতিপন্ন হয় তাহলে সে শিশুটিকে বিনা অপরাধে হত্যা করতে পারে। স্ত্রীদের ক্ষেত্রেও তাই।
ধর্ম সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কাজ করতে বাধ্য করে। তারা মনে করেন তারা ন্যায়সঙ্গত, কারণ তাদের তৈরি কল্পিত বড় ভাই এমনটিই বলেছেন।।