জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,সুন্দরবন,২৮ মে : মরমী গায়কের অমর সৃষ্টির একটা শব্দ পাল্টে বলা যেতেই পারে,’একদিন ঝড় থেমে যাবে, সুন্দরবন আবার শান্ত হবে।’ কিন্তু শান্ত হওয়ার আগে ওখানকার বাসিন্দাদের জন্য যে ক্ষয়ক্ষতি রেখে যাবে সেটা পূরণ করবে কে? দীর্ঘদিন ধরে একই গল্প চলে আসছে পরিবর্তন হচ্ছেনা। সেই পরিচিত দৃশ্য! আয়লা, আমফান, ইয়াস, ফণি, রিমেল নামক ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে প্রায় প্রতি বছর সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা গৃহহারা হয়ে পড়ে। নদীর বাঁধ ভেঙে জলের দাপটে ভেঙে পড়ে বাড়ি, নোনা জল ঢুকে নষ্ট হয় বিঘের পর বিঘে ক্ষেত জমি। প্রাণ রক্ষার তাগিদে আশ্রয়হীন, নিরন্ন মানুষগুলো সরকারি ত্রাণের আশায় দিন গুণতে থাকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করে। প্রিয়জনদের নিয়ে ছুটে বেড়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কোনোরকমে আশ্রয় জুটলেও সমস্ত লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এই কাহিনীর শেষ কবে হবে কেউ জানেনা!
প্রকৃতির তাণ্ডব রোধ করার সাধ্য কারও নাই। জোর করে রোধ করতে গেলে পরিণতি কী ভয়ংকর হয় তার উদাহরণ এই দেশে অসংখ্য আছে। ঘূর্ণিঝড় রোধ করা যাবেনা ঠিকই কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা করলে নদীর বাঁধগুলো তো শক্তপোক্ত করা যায়? অন্তত সেক্ষেত্রে নদীর বাঁধ ভেঙে বিপত্তি কম হতে পারে, ক্ষেত জমিগুলো নোনাজলের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। ল্যাণ্ডফলের দিন নিদ্রাহীন চোখে আতঙ্কে রাত কাটাতে হয় না এলাকার বাসিন্দাদের।
অত্যাধুনিক কম্পিউটার ও উপগ্রহ চিত্র ব্যবহার করে বর্তমানে আবহাওয়া সংক্রান্ত পূর্বাভাস প্রায় পুরোপুরি মিলে যায়। বেশ কয়েকদিন ধরে আবহাওয়া দপ্তরের পক্ষ থেকে রিমাল ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে খুব বেশি হলে তারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে গবাদি পশুদের নিয়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু নোনাজলের হাত থেকে ক্ষেত জমিগুলো অথবা বাড়িঘরগুলো ভেঙে পড়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে কী করে?
এবারও দেখা গেল নিজেদের জীবন বিপন্ন করে একদল যুবক নদীর বাঁধগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করছে। কোথাও নদীর বাঁধে পলিথিনের ত্রিপল ফেলে জলের আঘাত থেকে সেগুলো বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। কোথাও বা পাশ থেকে মাটি তুলে বাঁধ মজবুত করার চেষ্টা করছে। ওদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছে জনৈকা প্রবীণা। স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরে এই দৃশ্য খুবই মর্মান্তিক! উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পোশাক ছাড়া নিজেদের জীবন বিপন্ন করে যে যুবকগুলি ঝড় ও ভয়ংকর নদীর সামনে দাঁড়িয়ে বাঁধ রক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল এবং ভবিষ্যতেও যাবে তাদের জন্য কি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় না? দেওয়া যায়না পোশাক? ওই যে ওরা নিজেদের বাঁচানোর জন্য কার্যত খালি হাতে লড়াই করে যাচ্ছে এটা কার লজ্জা! গোটা বিশ্ব কিন্তু এই অসম লড়াই দেখছে।
এরপর বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কার্যত লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে নিজেদের সাধ্যমতো ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ওখানকার অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াবে। খাবার নিয়ে চলবে কাড়াকাড়ি। সরকারের পক্ষ থেকেও ত্রাণ সামগ্রী যাবে। তার উপর ভাগ বসাতে দ্বিধা করবেনা স্থানীয় নেতারা। কাক কাকের মাংস না খেলেও এদের কিন্তু অসহায় মানুষের ত্রাণ লুঠ করতে লজ্জা লাগবেনা!
ওদিকে শহরের এলিট নেতারা ত্রাণ বিলি করার সময় নির্লজ্জের মত বত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিত করে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। মানুষ মরুক ক্ষতি নাই, তাদের প্রচার দরকার। নাহলে শাশুড়ি হয়তো জামাই ষষ্ঠীতে নিমন্ত্রণপত্র পাঠাবেন না! হায়রে গণতন্ত্র!
সুন্দরবন এলাকার নদীগুলোর বাঁধ প্রায় প্রতিবছর ভেঙে পড়ে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে জীবন জীবিকার তাগিদে স্থানীয় বাসিন্দাদের আবার নতুন করে বাঁচার লড়াই শুরু হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণ করা হয়না।
বর্ষার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে প্রায় প্রতিবছর ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার জলে ভেসে যায়। পঞ্চাশের দশকে এলাকার মানুষদের স্বার্থে ঘাটাল পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে রাজ্যের তৎকালীন সেচমন্ত্রী একটি ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ওখানেই কাজ শেষ। মূল কাজ হয়নি। আজও আলোচনা হয়। তাহলে কি ধরে নিতে সুন্দরবন ও ঘাটাল স্থানীয় নেতাদের কাছে ‘সোনার ডিম পাড়া’ হাঁস স্বরূপ? ক্ষতি হবে, ত্রাণ আসবে, স্থানীয় নেতাদের পকেট ভরবে! তাই কি স্বাধীনতার পরেও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আজও কোনো সদর্থক উদ্যোগ নেওয়া হলোনা?
কথা হচ্ছিল সুন্দরবনের স্থানীয় বাসিন্দা নীহার মণ্ডলের সঙ্গে। কর্মসূত্রে তিনি বাইরে থাকেন। দুর্যোগের ইঙ্গিত পেয়েই তিনি ছুটে এসেছেন নিজের গ্রামে। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে নদী বাঁধ রক্ষা করার চেষ্টা করে গেছেন। মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়েছেন। তিনি বললেন,’সবচেয়ে আগে দরকার জঙ্গল মাফিয়া ও ভূমি মাফিয়াদের হাত থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করা। ঝড়ের দাপট থেকে দ্বীপ ভূমিকে রক্ষার জন্য নিয়মিত ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষরোপণ করতে হবে এবং গোষ্ঠী গড়ে দায়িত্ব দিতে হবে স্থানীয় যুবকদের। আর্থিক কারণে একেবারে সম্ভব নাহলেও যে জায়গায় নদী বাঁধ সবচেয়ে আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই অংশ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্মাণ করতে হবে।’
আসলে আমাদের দেশের বৃহত্তর মানুষের স্বার্থে কোনো পরিকল্পনা রচিত হলে ক্ষুদ্রতর মানুষের পকেট ভর্তির স্বার্থে সেগুলো ‘আরও আলোচনার দরকার’- এর অজুহাতে হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অথবা পরবর্তী সরকারের ঘাড়ে ফেলে দেওয়া হয়। এটাই চলে আসছে। ফলে গল্পটা একই থেকে যায়।।