মহারাজা পৃথু (Prithu) কামরূপ রাজ্যের রাজা ছিলেন। তাঁকে জলপেশ্বর ও বলা হয়। তিনি শুদ্রবংশীয় রাজা দেবেশ্বরের বংশজাত ছিলেন। তিনি বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুড়িয়ে ফেলা মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীকে ১২০৬ খ্ৰিষ্টাব্দে এবং ১২২৬ খ্ৰিষ্টাব্দে দিল্লীর মামলুক রাজবংশের নবম সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনকে পরাজিত করার জন্য প্ৰসিদ্ধ ছিলেন। অথচ পরিতাপের বিষয় এই যে বখতিয়ার খিলজির নামে বিহারের একটি শহরের নাম বখতিয়ারপুর রাখা হয়েছে এবং সেখানে একটি রেলওয়ে জংশনও রয়েছে ওই আফগান হানাদারের নামে । যেখানে আমাদের এক সফল হিন্দু রাজা পৃথুর নামে শিলালিপিও খুঁজতে গিয়ে হতাশ হতে হয় । এটাই হল ভারতের সেকুলার ইতিহাসবিদদের এক ঘৃণ্য কীর্তি । পরিহাসের বিষয় যে আসামের রাজা পৃথুর মতো বীরদের চেয়ে আমাদের দেশের বিদেশি হানাদার এবং ধ্বংসকারীদের সম্পর্কে ভারতীয়দের বেশি শেখানো হয় । এখানে বর্তমান আসামে সংঘটিত মহারাজা পৃথু ও হানাদার বখতিয়ার খিলজীর কিংবদন্তি যুদ্ধের গল্প বর্ণনা করা হল যাতে উত্তর-পূর্ব ভারত ইসলামি হানাদেরর হাত থেকে রক্ষা করেছিল ।
মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী ভারতের একটি সুপরিচিত ঐতিহাসিক চরিত্র। তিনি ছিলেন সেই বর্বর, ধর্মান্ধ ইসলামি হানাদার যিনি ভারতের বড় অংশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন এবং লুটপাট, মন্দির ভাঙ্গা ইত্যাদির মাধ্যমে ভারতীয় সভ্যতার অপূরণীয় ধ্বংস সাধন করেছিলেন। তিনি বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের জন্য পরিচিত ৷ বড় প্রাচীন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়… অমূল্য বই, পাণ্ডুলিপি, নথিপত্র ইত্যাদি কয়েক মাস ধরে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায় । কিন্তু আসামের মহারাজা পৃথু সম্পর্কে ভারতীয়রা খুব কমই জানেন , যিনি খিলজিকে এমন বিধ্বংসীভাবে পরাজিত করেছিলেন যে আফগানরা আর কখনও যুদ্ধ করেনি এবং কয়েক বছর পরে নৃশংস পরিনতির মুখোমুখি হতে হয় খিলজিকে । এটা বলা যেতে পারে যে আসামের রাজা পৃথুই ছিলেন ভারতীয় রাজা যিনি বখতিয়ার খিলজিকে হত্যা করেছিলেন, যদিও সরাসরি নয় ।
মহারাজা পৃথুর কাছে বখতিয়ার খিলজির পরাজয়ের গল্পটা ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দের । এক হিন্দু রাজা শপথ নেন, ‘বখতিয়ার খিলজি,তুই জ্ঞানের মন্দির নালন্দা পুড়িয়ে কামরূপ (আসাম) দেশে আসছিস… যদি তুই এবং তোর একজন সৈন্যও ব্রহ্মপুত্র পার হতে পারে, তবে আমি চণ্ডী (কামতেশ্বরী) মাতার শপথ করে বলছি যে আমি নিজেকে আগুনে আহুতি দেবো ।’ আর তিনি আর কেউ নন…তিনি হলেন মহারাজা পৃথু । এরপর ১২০৬ সালের ২৭ মার্চ আসামের মাটিতে একটি যুদ্ধ হয়েছিল যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা আছে । এটি এমন একটি যুদ্ধ যাতে খিলজির প্ৰায় ১২,০০০ ঘোড়সওয়ার ও বিশ হাজার পদাতিকের পুরো সৈন্যবাহিনী ধ্বংস হয়েছিল । মাত্ৰ ১০০ জন জীবিত ছিল । যারা যুদ্ধের ইতিহাস পড়েছেন তারা জানেন যে যখন দুটি সেনাবাহিনী যুদ্ধ করে তখন একটি সেনাবাহিনী হয় পরাজয় মেনে নিয়ে পালিয়ে যায় অথবা আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু, এই যুদ্ধে হানাদার বখতিয়ার খিলজীর মাত্র ১০০ জন সৈন্য জীবিত ছিল।
আসলে ১২০৬ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি তিব্বত আক্ৰমণ করার পরিকল্পনা করে।তিব্বতের বৌদ্ধ মঠসমূহ লুণ্ঠন করা ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাথে বঙ্গের পরম্পরাগত বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্ৰণ লাভ করার জন্য সে তিব্বত আক্ৰমণ করতে চেয়েছিল। এর জন্য তাকে কামরূপ ও সিকিম রাজ্যের মাঝখান দিয়ে যেতে হয়েছিল। রাজা পৃথু বখতিয়ার খিলজির সৈন্যবাহিনীকে তার রাজ্য দিয়ে যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন। কারন তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসকারীকে চিরতরে নিকেশ করতে চেয়েছিলেন । আর ওই আফগান হানাদারের উচ্চাকাঙ্খা তাঁকে সেই সুযোগ এনে দেয় । আজও, আসামের গুয়াহাটিতে সংরক্ষিত শিলালিপিতে এই যুদ্ধের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে ।
বর্ণনা অনুযায়ী, সে সময় মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি বিহার ও বাংলার অনেক রাজাকে জয় করে আসামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। আর তখনই ওই হানাদার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুড়িয়ে দেয় এবং হাজার হাজার বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু পণ্ডিতকে হত্যা করেন। পরবর্তী সময়ের আলাউদ্দিন খিলজির নালন্দাকে ধ্বংস করে আসাম হয়ে তিব্বতে যেতে চেয়েছিলেন। কারণ, সেই সময়ে, তিব্বত ছিল চীন, মঙ্গোলিয়া, ভারত, আরব এবং দূরপ্রাচ্যের দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, তাই খিলজি এটি দখল করতে চেয়েছিলেন … কিন্তু, তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন আসামের রাজা পৃথু।
খিলজি উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে এসে শিবির করেছিল। কিন্তু মহারাজা পৃথু শত্ৰুদলের রসদ যোগানের সব পথ বন্ধ করে দেন। বখতিয়ার খিলজির সৈন্যবাহিনী খরস্রোতা নদী পার করলে তিনি রাজা পৃথু সেতু ধ্বংস করে দেওয়ান । যাতে খিলজির বাহিনী পশ্চাদপসরণ করতে না পারে। আক্ৰমণকারী বাহিনী তিব্বতের খহটা পাহাড়ি অঞ্চলে প্ৰবেশ করে কঠোর প্ৰতিরোধের সামনে পড়ে ও পিছু ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু খিলজির নদী পার হয়ে পশ্চাদপসরণ ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ তার বাহিনীর খাদ্য যোগান কম ছিল ও রাজা পৃথুর বাহিনী তাদের সকল দিক থেকে ঘিরে আক্ৰমণ শুরু করেছিল।
মহারাজা পৃথুর উপজাতীয় যোদ্ধারা বিষাক্ত তীর, খুকরি, বর্শা এবং ছোট কিন্তু মারাত্মক তলোয়ার দিয়ে খিলজির সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করেছিলেন। পরিস্থিতি দেখে ভীত হয়ে খিলজি তার অনেক সৈন্য নিয়ে বন ও পাহাড়ের সুযোগ নিয়ে পালিয়ে যেতে লাগলো ! কিন্তু, আসামের মানুষ জন্মগতভাবে যোদ্ধা এবং আজও পৃথিবীর কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি । তারা তাদের পাতলা কিন্তু বিষাক্ত তীর দিয়ে সেই পলাতক খিলজিদের বিদ্ধ করেছিল ।
শেষ পর্যন্ত, খিলজি তার মাত্র ১০০ জন সৈন্যকে বাঁচাতে সক্ষম হন এবং রাজা পৃথুর সামনে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চাইতে শুরু করলেন । রাজা পৃথু তখন তার সৈন্যদের বন্দী করেন এবং খিলজিকে একাকী ঘোড়ায় বসিয়ে বলেন, ‘তুই আফগানিস্তান ফিরে যা । আর, রাস্তায় যার সঙ্গেই দেখা হবে তাকে বলবি যে তুইই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালিয়েছিস, এরপর রাজা পৃথুর মুখোমুখি হয়েছিলি তুই । ব্যস, এইটুকু বলবি তুই ।’
খিলজিকে এতটাই অপমান করা হয়েছিল যে, যখন তিনি তার নিজের জায়গায় ফিরে আসেন, তার গল্প শুনে তার নিজের ভাগ্নে আলী মর্দান তার শিরশ্ছেদ করে । এছাড়া ১২২৬ খ্ৰিষ্টাব্দে দিল্লীর মামলুক রাজবংশের নবম সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন কামরূপ আক্ৰমণ করে ও বৰ্তমান গুয়াহাটি পর্যন্ত এগিয়ে আসে। কিন্তু রাজা পৃথু তাকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করেন । অথচ মহারাজা পৃথুর মত এতবড় একজন ভারতীয় বীর সম্পর্কে দেশের আধুনিক প্রজন্ম কিছুই শোনেনি…অথবা পরিকল্পিত ভাবে তাদের শোনানো হয়নি ।।