প্রথম দৃশ্য : সময়কাল নব্বই এর দশক। একটি গ্রামে হিজড়াদের দল এসেছে নবজাতককে আশীর্বাদ করতে। বাড়ির উঠোনে চলছে ঢোলের বাজনা, গান আর নাচ। পাড়া- পড়শিরা এসে জুটেছে মজা দেখতে। তাদের মধ্যে আছে ছেলে- ছোকরাও। চটুল শব্দ ছুঁড়ে দিচ্ছে তাঁদের উদ্দেশ্য করে। কেউ কেউ আবদার করছে গোপন অঙ্গ দেখার।
দ্বিতীয় দৃশ্য : সময়কাল দুই হাজার চব্বিশ সাল। একটি স্কুলের মেয়ে প্রেমপত্র লিখে ভালবাসার প্রস্তাব দিচ্ছে আর একটি মেয়েকে। হৈ হৈ রব। প্রেমপত্র দেওয়া অপরাধ তার চেয়েও বেশি অপরাধ একটি মেয়ের আর একটি মেয়েকে লেখা।
তৃতীয় দৃশ্য : সময় কাল একবিংশ শতাব্দী। দুই রূপান্তরকামী নারী-পুরুষ একে অপরকে ভালবেসে বিয়ে করবে। মেয়েটি পুরুষে রূপান্তরিত হওয়ার আগে তার নারী শরীরকে ধার করে জন্ম দিতে চায় এক সন্তানের। সেই নারী গর্ভবতী। ব্যতিক্রমী দম্পতির ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। অগণিত মন্তব্যের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া, বেশিরভাগই কুমন্তব্য।
এবার অন্য কিছু গল্প বলি। এ গল্প পুরাকালের। আমরা কথায় কথায় বলি মান্ধাতার আমল। সেই মান্ধাতার জন্ম পিতৃগর্ভে। আমরা ভগীরথের স্বর্গ থেকে গঙ্গা আনার গল্প জানি। সেই ভগীরথের জন্ম দুই নারীর মিলনে।
কুরুবংশের আদি পুরুষ পুররবার মাতার নাম ইলা। যিনি বৈবস্বত মনুর পুত্র সন্তান ইল নামে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে নারী ইলাতে রূপান্তরিত হন।
সমুদ্র মন্থনের সময় বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করে অসুরদের কাছ থেকে অমৃতভাণ্ড ছিনিয়ে আনেন। শিব মোহিনীর আসল রূপ জেনেও মিলনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
মহাভারতে শ্রীখণ্ডী যিনি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অর্জুনের রথের সারথি হন।
অর্জুন-উলুপীর পুত্র ইরাবান কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের জয়ের কামনায় নিজেকে বলি দেন। তার আগে তাঁর বিবাহের শেষ ইচ্ছা জানান। এক রাতের জন্য কোনো নারী ইরাবানকে বিয়ে করতে রাজি হয় না। কৃষ্ণ নারীর রূপ ধরে ইরাবানের শেষ ইচ্ছা পূরণ করেন।
এবার বলি সিনেমার গল্প। বিখ্যাত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের চিত্রাঙ্গদা। নায়ক রুদ্র জন্মসময়ে শরীরে পুরুষ চিহ্ন নিয়ে জন্মেছে। কিন্তু তার শরীরের অভ্যন্তরে গুমরে গুমরে কেঁদেছে এক নারী। প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্ব। সেই নারীর আত্মপ্রকাশের ইচ্ছে প্রকট হয়ে উঠেছে চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে অভিনয়ের সময়। রুদ্র ভালবেসেছে পার্থকে। উপহার দিতে চেয়েছে নারী শরীর। বেছে নিয়েছে জটিল অস্ত্রোপচারের পথ। এক ইচ্ছেপূরণের অপূর্ণ গল্প।
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের নগরকীর্তন। পরিমল জন্মেছে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে পুত্র সন্তান হয়ে। কিন্তু পরিমল বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে খুঁজে পেতে থাকে পরি নামের মধ্যে। লুকিয়ে মায়ের লিপস্টিক মাখে। সেই পরি ওরফে পুঁটি একদিন ঘর ছাড়ে। তারপর একদিন দেখা হয় মধুর সঙ্গে। মধু একজন পুরুষ। পরি মধুকে ভালবাসে। মধুর বৌদির নারী শরীর দেখে নিজের অপূর্ণতায় কষ্ট পায়। পরিমলের পরি হয়ে ওঠা না ওঠার গল্প।
এবার কিছু ইংরেজি শব্দ বলি। যেসব শব্দের অভিধানিক ব্যাখ্যা ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে।
LGBTQ – – lesbian, gay, bisexual, transgender, queer ।
জন্মের সময় নারী শরীর বা পুরুষ শরীর ধারণ করলে বার্থসাটিফিকেটে তার sex female বা male । কিন্তু পরবর্তীতে সেই মানবশরীর নিজেকে কীভাবে দেখতে চাইবে সেটা সম্পূর্ণ আলাদা। নারী শরীর যদি নিজেকে নারী এবং পুরুষ শরীর নিজেকে পুরুষ হিসেবে মেনে নিলে কোনো সমস্যাই নেই। সমস্যা তখনই যখন নারী শরীরে পুরুষ আর পুরুষ শরীরে নারী বন্দী হয়ে থাকে। এদের যন্ত্রণা সমাজ ভেবেও দ্যাখে না। উপহাস করে। সমাজ তাদের transgender বলে একঘরে করে দেয়। তৃতীয়লিঙ্গরাও একইভাবে উপেক্ষার পাত্র।
Sexual orientation is not a choice.
কোনো মানব শরীর নির্ধারণ করতে পারে না তার sexual orientation ।নির্ধারণ করে তার মস্তিষ্ক। তাই এসব কিছু সেই শরীরের হাতে নেই। কোনো থেরাপি দিয়েও সম্পূর্ণ সুস্থ করা যায় না। কারণ এটা কোনো শারীরিক বা মানসিক অসুখ নয়। তারা আমার আপনার মতোই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষ।
এই সব রুদ্র, পরি এরা আমাদেরই ঘরের ছেলে। আমাদের নতুন করে ভেবে দেখার সময় এসেছে। সময় এগোচ্ছে, সমাজ ও সমাজের মানসিকতা যুগের তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলুক এটাই কাম্য ।।

