এইদিন ওয়েবডেস্ক,কাবুল,০১ এপ্রিল : দিনটা ছিল ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ । আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের বাসিন্দা ২৭ বছরের তরুণী ফারখুন্দা মালিকজাদা( Farkhunda Malikzada) সকালে বাজারে গিয়েছিলেন । তখনই তার নজরে পড়ে একজন ব্যক্তি তাবিজ বিক্রি করছে । তিনি তাবিজ বিক্রেতার কাছে তাবিজ কিনতে গিয়েছিলেন । কিন্তু ফারখুন্দার সঙ্গে ওই তাবিজ বিক্রেতার কোন কারণে বচসা শুরু হয়ে যায় । প্রচুর লোকজন জড়ো হয়ে যায় সেখানে । সেই সময় তাবিজ বিক্রেতা ওই তরুণীর বিরুদ্ধে কোরান পোড়ানোর মিথ্যা অভিযোগ তোলে । ধর্মান্ধ মুসলিমরা তার কথায় বিশ্বাস করে । তারপর তারা যা নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল তা আজও বিস্মৃত হয়নি বিশ্ববাসী । ইসলামী ধর্মান্ধতা ও অসহিষ্ণুতার নির্মম শিকার হতে হয় ফারখুন্দা মালিকজাদাকে ।
শোনা যায়, শত শত যুবক ফারখুন্দা মালিকজাদাকে ঘিরে ধরে । ধর্মান্ধ জনতা ফারখুন্দাকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে যায় । তাকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি পাথর ছোড়া হয় প্রথমে । সাহায্যের জন্য চিৎকার করে লোকজন ডাকাডাকি করে তরুনী । কিন্তু কেউ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি । অসহায় তরুণী একটি মার্কেটের কাছে ছুটে পালিয়ে আসেন । কিন্তু
লাঠি ও লোহার রড নিয়ে পিছু ধাওয়া করে ধর্মোন্মাদের দল । শুরু হয় নির্মমভাবে পেটানো । সেই দৃশ্য কেউ নিজের স্মার্টফোনে ভিডিও রেকর্ড করে রেখে দিয়েছিলেন । বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে । ভিডিওতে দেখা গেছে তরুণী সাহায্যের জন্য কাতর আকুতি করছেন । কিন্তু কেউই তাকে তাকে বাঁচাতে আসেনি । হঠাৎ একটা লাঠি বা লোহার রড দিয়ে কেউ তার মাথায় সজোরে আঘাত করে৷ তরুণী একটি দোকানের শোকেসের উপর উল্টে পড়ে যান । তারপরও তাকে নিস্তার দেয়নি ইসলামি মৌলবাদীদের দল । মেয়েটিকে সেখান থেকে বের করে এনে এলোপাথারি লাঠি পেটাানো হয় ।
জানা গেছে, অর্ধমৃত ফারখুন্দা মালিকজাদাকে এরপর রাস্তার মধ্যে রেখে একটি টয়োটা গাড়ির চাকায় পিসে দেওয়া হয় । গাড়ির হ্যাচব্যাকের পেছন বেঁধে তাকে প্রায় ১০০ মিটার টেনে নিয়ে যাওয়া হয় । তখন ঘটনাস্থলে পুলিশেও ছিল । ইচ্ছা করলে পুলিশ মেয়েটিকে বাঁচাতে পারতো,কিন্তু বাঁচায়নি । উল্টে পুলিশ ঘটনাস্থলের আশেপাশে যান চলাচলের নির্দেশ দেয়। এদিকে তরুণীর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর, হত্যাকারীয়া তার দেহ কাবুল নদীর তীরে টেনে নিয়ে যায় । সেখানে শুকনো গাছের পাতা ও খড়কুটোয় আগুন ধরিয়ে তরুনীর মৃতদেহটি তাতে ফেলে পালিয়ে যায় ।
বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলে ঘটনার তদন্ত শুরু করে আফগান সরকার। পুলিশি তদন্তে প্রমাণ হয় যে ফারখুন্দা মালিকজাদার বিরুদ্ধে কোরান পড়ানোর মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছিল । এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ ৪৯ জনকে গ্রেফতার করে । তার মধ্যে ৩ জনকে ২০ বছর, ৮ জনকে ১৬ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয় । একজন কুড়ি বছরের যুবকও এই হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে ছিল । কিন্তু তার পরিবার তার ভুয়ো জন্ম সংশাপত্র দেখিয়ে তাকে নাবালক সাজাতে সক্ষম হয়। ফলে তার সাজাও কম হয় এবং তাকে ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় । এছাড়া ১১ জন পুলিশকর্মী তরুনীকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য তাদের প্রত্যেককে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল । পরবর্তীকালে আফগানিস্তানের সলিডারিটি পার্টির সমর্থনে কাবুলে ফারখুন্দা মালিকজাদার একটি স্মৃতিসৌধ নির্মান করা হয় ।
ফারখুন্দার হত্যাকাণ্ড ইসলামিক রাষ্ট্রে নারীর অধিকারের অন্ধকার দিককে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল । একটি ইসলামী রাষ্ট্রে একবিংশ শতাব্দীতেও একজন নারীর জন্য জীবন কতটা বিপজ্জনক তার ধ্বংসাত্মক প্রতীক হয়ে আছেন
নিহত আফগান তরুণী ফারখুন্দা মালিকজাদা । আজ তালিবানের জমানায় আফগান নাগরিকরা যে পরিমাণ অত্যাচারের মুখোমুখি হচ্ছে তা তাদের কট্টরপন্থী মানসিকতার ফলশ্রুতি বলেই মনে করছেন অনেকে ।
ফারখুন্দা মালিকজাদার হত্যার মুহূর্তের ভিডিওটি নিজের এক্স হ্যান্ডেলের শেয়ার করেছেন আজ্জাত আলসালেম নামে জনৈক এক ব্যবহারকারী । ভিডিও শেয়ারের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন, ‘কোরান পোড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত আফগান মেয়ে ফারখান্দার কথা মনে আছে ! আফগানিস্তানের মুসিমদের দ্বারা তাকে পাথর ছুড়ে, পিটিয়ে, গাড়ির পিছনে টেনে নিয়ে গিয়ে হত্যার পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল! হত্যা করা পর্যন্ত চিৎকার করতে থাকে ফারখান্দা ! প্রতি বছর হাজার হাজার শিকারের মধ্যে সে একজন ছিল !’