আমিরুল ইসলাম,ভাতার(পূর্ব বর্ধমান),০২ মার্চ : মাথা গোজার ঠাঁই বলতে ছিল একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর । কিন্তু সেই কুঁড়েঘরে কোনরকম ভাবে আগুন ধরে ভস্মীভূত হয়ে যায় । তারপর থেকে ঝড়-বৃষ্টি আর প্রবল দাবদহে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিন কাটছিল এক অশীতিপর বৃদ্ধের । আশা করেছিলেন তার এই দুর্দশা দেখে মন গলবে স্থানীয় পঞ্চায়েত ও প্রশাসনের । ঘরের আশায় বারবার ছুটে গিয়েছিলেন দুই সরকারি দপ্তরে । কিন্তু তাকে প্রতিবারই হতাশ হয়েই ফিরে আসতে হয়েছে । মন গলেনি পঞ্চায়েত আর প্রশাসনের বাবুদের । তীব্র হতাশার মধ্যে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছিলেন ওই বৃদ্ধ । তখনই তার কাছে দেবদূতের মতো আবির্ভূত হলেন পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার থানার ওসি প্রসেনজিৎ দত্ত । সদ্য থানায় দায়িত্ব নেওয়া প্রসেনজিৎবাবু বৃদ্ধের দিকে বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত । তার উদ্যোগে ঘর ফিরে পেলেন ভাতার বাজারের বাসিন্দা মানিক বিশ্বাস নামে বছর ৬৫-এর ওই বৃদ্ধ । শুধু তাই নয়, তিনি বৃদ্ধের দুবেলার খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন থানার ক্যান্টিনে । কিনে দিলেন বেশ কিছু পোশাক পরিচ্ছদ । ভাতার থানার ওসির এই মানবিকতায় আপ্লুত বৃদ্ধ মানিকবাবু এখন বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ।
জানা গেছে, ভাতার বাজারে মাটির ছিটেবেড়া দেওয়াল ও খড়ের ছাউনি দেওয়া এক চিলতে ঘরের মধ্যে বসবাস ছিল মানিক বিশ্বাসের ৷ স্ত্রী বাসন্তী বিশ্বাস বহুদিন আগেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৷ একমাত্র ছেলের সুখেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন । কার্যত বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় তাকে । এখন মানিক বিশ্বাসের সংসার বলতে ১২টি ছাগল আর তিনি ।
জানা গেছে,বেশ কয়েক বছর আগে মানিকবাবুর কুঁড়েঘরে কোন রকম ভাবে আগুন ধরে যায় । নিমেষের মধ্যে ভস্মীভূত হয়ে যায় সমগ্র ঘরটি । ঘর হারিয়ে ১২টি অবলা পশুকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে হয় তাকে । মানিক বাবু বলেন,’আমি আমার ঘরের বিষয়ে ভাতার গ্রাম পঞ্চায়েতে একাধিকবার গেছি। বেশ কয়েকবার আমার ঘরের ছবিও করে নিয়ে গেছে ওরা । কিন্তু আমার ঘরের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। আমার বাড়ির কিছুটা দূরেই রয়েছে বিডিও অফিস । সেখানেও জানিয়েছিলাম । বিডিও অফিস থেকে আমার হাতে একটা ত্রিপল ধরিয়ে দেওয়া হয় । ব্যস,ওইটুকুই সরকারি সাহায্য পেয়েছি আমি ।’ তবে তিনি জানান যে তিনি ভাতার থানার ওসিকে নিজের অসহায় অবস্থার বিষয়ে কিছু জানাননি ।
জানা গেছে, ভাতার থানার ওসি প্রসেনজিৎ দত্তকে নিজের অসহায় অবস্থা সম্পর্কে কিছু না জানালেও কোনরকম ভাবে তার কানে মানিক বাবুর কথা পৌঁছে যায় । বৃদ্ধের কথা শোনার পরই ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়ে ওই বৃদ্ধের দিকে তিনি সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেন । তিনি বৃদ্ধকে একটা মাথা গোঁজার জন্য ঘর তৈরি করে দেন । ঘরে বিদ্যুতের সংযোগও করেছেন তিনি । বৃদ্ধের শোবার জন্য বৃদ্ধকে দেওয়া হয় একটি খাট ও বিছানাপত্র ।
কিন্তু বার্ধক্য জনিত কারণে কাজকর্ম করতে পারেন না মানিকবাবু । তাই থাকার ব্যবস্থা হলেও তিনি খাবেন কি তিনি ? এটা নিয়েও ভেবেছেন ভাতার থানার মানবিক ওসি । জানা গেছে যে ভাতার থানার ক্যান্টিনে ওই বৃদ্ধের দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন প্রসেনজিৎবাবু ।
ওসির এই প্রকার মানবিকতায় আপ্লুত বৃদ্ধ মানিক বিশ্বাস বলেন,’আজ বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পেলাম । আমি ওনাকে কিছু জানাইনি, অথচ উনি খবর পেয়ে আমায় এত কিছু করে দিয়েছেন । আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব ভাতার থানার বড়বাবু যেখানেই থাকুন না কেন উনি সবসময় যেন সুস্থ থাকুন । ভগবান ওনার ও ওনার পরিবারের মঙ্গল করুন ৷’
ভাতার বাজারের বাসিন্দা সন্দীপ হাজরা বলেন,’পুলিশও যে এত সমাজসেবী হয় এই প্রথম দেখলাম । ওই বৃদ্ধের প্রতি ভাতার থানার ওসি যে মানবিকতা দেখিয়েছেন তাতে আমরা আপ্লুত ।’
তবে এই প্রথম ঘটনা নয়, ভাতারে দায়িত্ব নিয়ে আসার পরেই মানবিকতার নজির সৃষ্টি করেছেন ওসি প্রসেনজিৎ দত্ত । সম্প্রতি ভাতার থানার অন্তর্গত বলগোনার বাজারে দুই ভিক্ষাজীবি কিশোরকে ভিক্ষা করতে দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রসেনজিৎবাবু । পার্শ্ববর্তী গ্রাম সন্তোষপুরের বাসিন্দা ওই কিশোরের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি । শুধু তাই নয়, দুই কিশোরের মায়ের কর্মসংস্থানের বিষয়েও তিনি ভাববেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন ।
পূর্ব বর্ধমান জেলার এসডিপি ক্রাইম সুরজিৎ মন্ডল বলেন,’উনি যেখানেই দায়িত্ব নিয়ে যান সেখানেই নানান সমাজসেবামূলক কাজ করে থাকেন। ওনার জন্য আমরা গর্বিত। ভাতার বাজারের এক ব্যক্তির থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন শুনে সত্যিই খুব গর্ব অনুভব করছি ।’।