এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,২৭ ফেব্রুয়ারী : রেশন দুর্নীতির তদন্তে গিয়ে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) আধিকারিকদের ওপর মারাত্মক হামলার পর থেকেই বেপাত্তা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সন্দেশখালির ‘ত্রাস’ শেখ শাহজাহান । পঞ্চাশ দিনের অধিক সময় আত্মগোপন করে থাকা শাজাহানকে আজ ও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি । রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের দাবি যে পুলিশের সহায়তায় শাজাহান কখনো বাংলাদেশ কখনো ভারত করে বেড়াচ্ছে । অর্থাৎ তিনি শাজাহানকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দলের নাগালের বাইরে রেখে দেওয়ার জন্য সরাসরি রাজ্য পুলিশের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন । রবিবার তৃণমূল কংগ্রেসের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড অভিষেক ব্যানার্জি দাবি করেছিলেন যে হাই কোর্টের নির্দেশের কারণেই রাজ্য পুলিশ গ্রেফতার করতে পারছে না শাহজাহানকে । তাই তৃণমূল নয়, শেখ শাহজাহানকে আড়াল করছে বিচার ব্যবস্থা । কিন্তু সোমবার অভিষেক ব্যানার্জীর সেই দাবিকে কার্যত নস্যাৎ করে দিয়ে কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়েছে যে শাহজাহান শেখকে গ্রেফতারি কোন স্থগিতাদেশ নেই । পুলিশ চাইলেই তাকে গ্রেফতার করতে পারে ।
যাকে নিয়ে গোটা দেশ জুড়ে তোলপাড় চলছে, সেই শাহজাহান শেখ কে ? কিভাবে হল তার উত্থান ? রাজ্যে বামফ্রন্টের জমানায় উত্থান হওয়া শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে খুন,জোর করে জমি জবরদখল,নারী ধর্ষণের মতো মারাত্মক সব অভিযোগ উঠছে । অনেকে সন্দেশখালির শেখ শাহজাহানকে বাংলার আতিক আহমেদ, মুখতার আনসারী বা শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তুলনা করছেন ।
বামফ্রন্ট জমানায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করা(!) সন্দেশখালির মুকুটহীন সম্রাট শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে উঠেছে বিজেপি নেতাদেরকে খুনের অভিযোগ । সন্দেশখালিতে ২০১৯ সালে তিনজন বিজেপি কর্মীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় শাহজাহানের নাম জড়িয়ে ছিল । ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর ৮ জুন শাহজাহানের নেতৃত্বে প্রায় ১৫০ জনের একটি দল স্থানীয় বিজেপি নেতা দেবদাস মণ্ডলের বাড়িতে ঢুকে হামলা চালায় । বাড়িতে আগুন লাগানো, লুটপাট সহ দেবদাসকে তারা তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে । দেবদাসের বাবা প্রদীপ মণ্ডলকেও মাথায় গুলি করে হত্যা করে শাহজাহানরা । খুন হন আর এক বিজেপি নেতা সুকান্ত মণ্ডলও । আর এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড হলো তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান ! শাহজাহান ও তার বাহিনীর জনের বিরুদ্ধে খুনসহ বিভিন্ন গুরুতর ধারায় এফআইআর দায়েরও করা হয় ।
২০২২ সালের ২৫ জুন শাহজাহানের বিরুদ্ধে রাজ্য বিদ্যুত্ বণ্টন পর্ষদ-এর সরবেড়িয়ার কাস্টমার সেন্টারে স্টেশন ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে তার উপর হামলার অভিযোগ রয়েছে । ওই ঘটনাতেও বহু গুরুতর অভিযোগে শাহজাহানের বিরুদ্ধে এফআইআর রজু করা হয় । ওই দিনই সরবেড়িয়া মোড়ে বাসন্তী হাইওয়ে অবরোধের সময় শাহজাহান ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে লুটপাট, পাথর ছোড়া, ভাঙচুর প্রভৃতি গুরুতর অভিযোগ ওঠে । শাহজাহানের বিরুদ্ধে শুধু খুনই নয়, নারী পাচার, গরু চোরাচালান, সোনা ও মাদক চোরাচালানের জন্য ৪০টি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছে । এত কিছু অভিযোগের পরও তৃণমূল কংগ্রেসের স্নেহধন্য হওয়ায় শেখ শাহজাহানের টিকিও ছুঁতে পারিনি পুলিশ ।
বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ,শাহজাহান শেখ তার মনোনয়নপত্রে দেখিয়েছেন যে তার বার্ষিক আয় মাত্র ১৯ লাখ ৮৩ হাজার টাকা যেখানে তিনি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। শাহজাহান শেখের অনেক ভবন আছে, অনেক একর জমি আছে। কিছুদিন আগে কলকাতায় পার্ক সার্কাসে তিনি নতুন বাড়ি কিনেছেন বলে দাবি করা হয় । বিলাসবহুল এই বাড়ির দাম কয়েক কোটি টাকা। তার জমি ও ভবনের মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা বলে মনোনয়নপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে । সরবেরিয়া মোড়ে ইটের ভাটা এবং একটি শপিং কমপ্লেক্সও শাহজাহান শেখের নামে।
কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক কি করে হলো এক বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী ?
অভিযোগ ওঠে যে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ওই সমস্ত এলাকা দিয়ে দেদার গরু, নারী, সোনা ও মাদক চোরাচালান হয় । আর এই অবৈধ কারবারের পুরোটা শেখ শাহজাহান তার নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে । এছাড়া বসিরহাট মহকুমার সন্দেশখালিতে, মাছের চাষ করা হয় বৃহৎ পরিসরে । শাহজাহান মাছের ভেড়ি করার জন্য গ্রামবাসীদের স্বল্প মূল্যে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা অথবা জবর দখল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ । এভাবে হাজার হাজার একর জমি শেখ শাহজাহানের দখলে চলে গেছে । এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট(ইডি) যে কুড়ি হাজার কোটি টাকার রেশন দুর্নীতি মামলার তদন্ত করছে তাতেও নাম জড়িয়েছে শাহজাহানের । এমন একজন কুখ্যাত নেতা এরপরেও জেলের বাইরে কি করে থাকে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে । এই বিষয়ে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকাও সন্দেহের তালিকায় রয়েছে ।
প্রশ্ন ওঠে যে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস কেন চাইছে না শাজাহান জেলে যাক ? অভিজ্ঞ মহলের মতে, এর পিছনে রয়েছে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি । এক্ষেত্রে সিপিএম পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকারের নীতিতেই বর্তমান শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস চলছে বলে অভিযোগ উঠছে ।
প্রসঙ্গত,পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় সর্বাধিক মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে । বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পাঁচটি লোকসভা আসন রয়েছে -ব্যারাকপুর, দমদম, বারাসাত, বনগাঁ এবং বসিরহাট। ওই পাঁচটি লোকসভাই বর্তমানে তৃণমূলের দখলে । এক সময়ে লোকসভা গুলি ছিল সিপিএমের । শাহজাহান তৃণমূলে আসার পর লোকসভাগুলি দখল করে নেয় মমতা ব্যানার্জির দল । আর এর পিছনে শেখ শাহজাহানের ভূমিকা সব থেকে বড় বলে মনে করা হয় । এখন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে শেখ শাহজাহান যদি জেলে চলে যায় তাহলে ঐ সমস্ত লোকসভা কেন্দ্রগুলি তৃণমূলের হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে । এখন দেখার বিষয় কলকাতা হাইকোর্টের স্পষ্ট বিবৃতির পর কবে শেখ শাহজাহানকে পুলিশ গ্রেফতার করে ।।