বিচারসভায় ঠিক হল, আমাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হবে।
সময়টা উনিশশো বাহান্ন’র বেশ আগে। ওদের কাছে আমার অপরাধ ছিল অমার্জনীয়!
আমি লুকিয়ে শিক্ষা হয়েছিলাম। বালিকা বধূর খাতায় ভালোবাসছিলাম…
বৈধব্য নেমে এলো মেয়েটির সিঁথিতে।
ওরা প্রকাশ্যে বললো, বলেছিলাম পড়াশুনা মেয়েদের পাপ!
জনান্তিকে বললো, মেয়েদের এত ভালোবাসা ছড়ালে ভয় দূর হয়ে যাবে! ওদের শাসন বয়কট করবে পৃথিবী…
আমার জন্য বিচারসভা বসল খুব তাড়াতাড়ি।
বিশাল গর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি। চারিদিকে উল্লাস। আমার দিকে লক্ষ্য স্থির। কে ছুঁড়বে আমার মুখে, বুকে, চোখে, সাহসে…সরগরম আলোচনা
হঠাৎ মূক ও বধির মানুষটা ছুটে এলো কোত্থেকে! সবার পায়ে ধরলো। বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদলো। মাথা ঠুকলো…উল্লাস বাড়লো।
আমার হাত ভেঙে গেল। পা, বুক, পাঁজর, কণ্ঠ…
ওরা চলে যাওয়ার পরে সেই গর্তের চারিদিকে আমায় জড়িয়ে রাখলো মূক ও বধির মানুষটা।
তারপর বাহান্ন এলো। মানুষটা তার অশ্রু মুছে আগুন হলো। আগুন থেকে জন্ম নিল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার…
তাদের ফুসফুসে ফোঁস! চোখে লাভা! বুকে টগবগে রক্ত!
আমি ভাঙা শরীরে হাঁটছিলাম। তোতা পাখির ঠোঁটে গান দিতে হবে! শাপলা তুলে প্রেমের হাতে দিয়ে বলতে হবে, ভালোবাসো…ভালোবাসো…
গুলি এগিয়ে এলো আমার দিকে। এত সাহস তোর এখনো? এত নরম গায়ে এগোতে চাস?
মৃত্যুই তোর শ্রেয়!
গুলি আরো কাছে এলো…কাছে এলো…
আগুন গুলো জমাট বেঁধে ছুটে এলো সামনে।
খবরদার! টগবগে রক্ত আমার সামনে। ওরা গুলি ছুঁড়েই চললো।
ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল রফিক, সালাম…আরো কত শত তেজ!
ভয় পেলো ওরা! আশ্চর্য! সামান্য আমাকে বাঁচাতে
বলিদান! পিছোলো এক পা…দু পা…
ঠিক হলো, আমাকে রাখা হবে আমার স্থানে।
অলস দুপুরে মূক ছেলেটার স্বপ্নের রাজকন্যা বাগানের গাছে দোল খায়…তেঁতুল চোষে।
ছেলেটি চোখ দিয়ে গলগল করে আমায় ডেকে আনে। মেয়েটি হাসে, ভীষণ হাসে।
স্নান সেরে ছেলেটির মা হাঁড়িতে চাল তোলে। বাপ’টা আগে মাতাল ছিলো, এখন ভালোবাসা শিখেছে। বউয়ের গলায় পুঁতির মালা পরিয়ে দেয় একখানা…বলে, চুমু দেবে?
আমি চুপ করে সে মায়ের আঁচলে লুকিয়ে থাকি তখন। আমার যে সময় সময় নাম বদলে যায়!
এই এখন যেমন লজ্জা!
এখন আর গুলি টুলি আসে না। একুশ আসে।
সারাদিন আমার নাম হয়ে যায়… আ মরি মাতৃভাষা!