কর্পোরেট দুনিয়ায় কর্মরতা সৃজা রাতদিন ইংরেজী কপচাতে কপচাতে দেশ বিদেশ ঘুরছেন। ওনার আশেপাশের মানুষগুলোও বুঝি এই ইংরেজীর চক্করে পড়ে নিজেদের মাতৃভাষা ভুলে গেছে বা গেছেন। আজ আগে থেকে ফিক্সড হয়ে থাকা সময়ে কনফারেন্স কলটা করতে গিয়ে তড়িঘড়ি চেম্বারে ঢোকার সময় হঠাৎ করেই পা টা ঘষে গিয়ে ব্যথা পেতেই মুখ থেকে একটাই শব্দ বেরিয়ে এল, ‘উফ মাগো!’
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক অনিমেষ বাবুর সকালটা শুরু হয় ঘুম চোখে ছুটতে ছুটতে স্কুলে গিয়ে। ক্লাসের পর ক্লাস নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে ফেরেন সেই বিকেলে। তারপর নিজের একাকিত্ব কাটাতে একটু ফ্রেশ হয়েই ছোটেন বন্ধুদের সাথে মেট্রোপলিটন ক্লাবে আড্ডা মারতে। সেখানে আবার সবকিছুতেই শুধু ইংলিশ চলে। থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়ের এই একঘেয়ে জীবনে যদিও ওনার তেমন কোন অসুবিধা হয় নি তবু আজ যখন স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ করেই দেখলেন ফুলওয়ালা ছেলেটাকে, পথের এক বয়স্কা ভিক্ষুককে সে স্বযত্নে রাস্তা পার করিয়ে একটা কেক কিনে হাতে ধরিয়ে দিল, অনিমেষ বাবুর মুখ থেকে আপনা আপনিই একটা শব্দ বেরিয়ে এল, ‘বাহ্।’
তথা কথিত উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র পুত্রবধূ ঐশ্বর্য রায় চৌধুরী হাই সোসাইটির চালচলনে এতটাই নিয়োজিত অন্তপ্রাণ যে পারলে তো উনি বাড়ির সর্বক্ষনের সাহায্যকারী মানুষগুলোকেও বিদেশী কালচারে ডুবিয়ে রাখতে চান, কিন্তু সেই মানুষটাই যখন সারাদিনের অক্লান্ত ছোটাছুটির পর মধ্যরাতে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিতে যান মুখ থেকে একটাই শব্দ বেরিয়ে আসে, ‘ আহ্, কি শান্তি’।
কর্মসূত্রে অন্য রাজ্যে বসবাসকারী অনির্বাণ বসু পেশায় একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার হওয়ায় বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের সাথে ব্যস্ত থাকলেও বাংলায় কথা বলা ‘নৈব নৈব চ’।
তবু আজ অফিসে হঠাৎ করে দেখা হওয়া পূর্ব পরিচিত কোন এক অবাঙালী ভদ্রলোককে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলতে শোনেন, কেএএএমন আছেএন মিস্টার বাসু?’ মনটা সারল্যে ভরে যায়। মুখ থেকে বেরিয়ে আসে কয়েকটি শব্দ, ‘ভালো আছি, খুব ভালো আছি’। সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা ছেলে-মেয়েগুলো রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে যেন। এরা যে সব একসাথে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কি ভাষায় কথা বলছে কিছুই বুঝতে পারছেন না দীর্ঘ পঁচিশ বছর চৌরাস্তার মোড়ের পুরনো ফুচকা ব্যবসায়ী। কান খাড়া করে শুনছেন তো সবই কিন্তু বুঝতে ছাই কিছুই পারছেন না। কিন্তু যখন কানে এলো, ‘আমি কিন্তু বেশি ঝাল দিয়ে ফুচকা খাব’,কিংবা ‘আমার তো জল দিয়েই ফুচকা খেতে ভালো লাগে’ অথবা ‘কাকু, আমারটা ঝাল ছাড়া হবে’, তখন মনটা খুশি হল। মনে মনে ভাবলেন, যাক বাবা, শুনেও শান্তি।
বন্ধু অবন্তিকার জন্মদিনের নেমন্তন্ন রক্ষা করতে মিসেস চৌধুরী চলেছেন দক্ষিণের অতি আধুনিক এক ‘আবাসনে’। প্রথমে তো কেউ কিছুতেই বাড়িতে জন্মদিন পালনের পক্ষপাতি ছিলেন না কারণ হল অবন্তিকার ছেলে-বউ। সারাদিন কম্পিউটারের সামনে বসে থাকে আর ফড়ফড় করে ইংরেজী ঝাড়ে। অসহ্যকর অবস্থা। তবে অনেক কাকুতি মিনতি করেও যখন বাইরে জন্মদিন পালনের ইচ্ছেটা পূর্ন হয় নি তখন বাধ্য হয়েই ওদের বন্ধু গ্রুপটা চলেছে অবন্তিকার বাড়ি। বেল বাজানোর পর দরজা টা খুলে যেতেই মিসেস চৌধুরী ‘ভাল্লাগেনা ছাই’ বলে সামনে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। সামনে দাঁড়িয়ে আছে অবন্তিকার ছেলে আর ছেলের বউ। ওরা দুজনেই একসাথে বলে উঠল, ভাল্লাগেনা! কেন আন্টি, আস্তে কোন অসুবিধা হয়েছে? মিসেস চৌধুরী একগাল হাসি দিয়ে হাতের মিষ্টি প্যাকেটটা সামনের দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আর গদগদ হয়ে বললেন, কোন অসুবিধা নেই বাবা, কোন সমস্যাও নেই। এবার শুধু আনন্দ আর আনন্দ।
ভাষা, তার উপরে মাতৃভাষা আসলে তো শুধু ভাষা নয়, শুধু মাত্র যোগাযোগের মাধ্যমও নয়! ভাষা হল আবেগ, মনের শান্তি, সুখ দুঃখের সাথী।ভালোবাসার আরেক নাম হল মাতৃভাষা।।