এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,৩১ জানুয়ারী : ১৯৮৫ সালে টলিউডের আকাশ থেকে খসে পড়ে ভারতীয় সিনেমার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এক নক্ষত্র- মহুয়া রায়চৌধুরী । অপরূপা সুন্দরী মহুয়ার শরীরের অর্ধেকের বেশি অগ্নিদগ্ধ হয় । এগারো দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ওই বছর ২২ জুলাই দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত নার্সিং হোমের আট তলায় ৭২২ নম্বর ঘরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । মাত্র ২৬ বছর বয়সে ওই অভিনেত্রীর মৃত্যু আজও রহস্য মোড়া । সত্যিই সেদিন তিনি কেরোসিন স্টোভ দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন কিনা, আজও তার রহস্য উদঘাটন হয়নি ।
কলকাতার দমদমের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৫৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন হয় মহুয়া রায়চৌধুরী । যদিও তখন তার নাম ছিল শিপ্রা রায় চৌধুরী । ‘মহুয়া’ নামটা তাকে অভিনয় জীবনের শুরুর দিকে পরিচালক তরুণ মজুমদার দিয়েছিলেন । তরুণ মজুমদার তাকে নিজের মেয়ের মত স্নেহ করতেন । মহুয়ার বাবা নীলাঞ্জন রায় চৌধুরী ছিলেন পেশায় একজন নৃত্যশিল্পী । পরিবারের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বেশিদুর পড়াশোনা করতে পারেননি মহুয়া । তবে ছোটবেলা থেকেই তার নাচের দক্ষতা ছিল । মাত্র ৭ বছর বয়সে পাড়ার জলসায় তিনি সুচিত্রা সেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখার্জীর মত প্রখ্যাত শিল্পিদের সামনে নৃত্য পরিবেশন করেন । সেই সুবাদে পরিচালক তরুণ মজুমদারের নজরে পড়লে শ্রীমান পৃথ্বীরাজ নায়িকার রোল পান মহুয়া । তখন থেকেই তরুণ মজুমদারের দেওয়া নতুন নাম ‘মহুয়া’ বলে পরিচিত হন তিনি । মহুয়াকে সন্ধ্যা রায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মত অভিনেত্রীর নিজের হাতে অভিনয় শিখিয়েছিলেন ।
শ্রীমান পৃথ্বীরাজের পর ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে অভিনয় করেন মহুয়া । বক্স অফিসে ব্যাপক সাফল্য পায় ছবিটি । তারপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি । মোট ৯০ টি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন মহুয়া রায় চৌধুরী । এক একটা ছবির জন্য তোর পারিশ্রমিক ছিল প্রায় ১ লক্ষ টাকা করে । তার অভিনীত ‘বাঘ বন্দি খেলা’, ‘সেই চোখ’, ‘কবিতা’, ‘বেহুলা লখিন্দর’, ‘ঘটকালি’, ‘পাকা দেখা’, ‘প্রিয়তমা’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘শেষ বিচার’, ‘সুবর্ণগোলক’, ‘সাহেব’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘ফাদার’, ‘ইমনকল্যাণ’, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘লালগোলাপ’, ‘পারাবত প্রিয়া’, ‘শত্রু’-সহ আরও অসংখ্য ছবি দর্শকদের মন জয় করেছিল ।
অভিনয় করেছিলেন ম্যাটিনি আইডল উত্তম কুমারের সাথেও । এছাড়া দীপঙ্কর দে, সন্তু মুখোপাধ্যায়, সমিত ভঞ্জ, অনুপ কুমার, তাপস পাল, চিরঞ্জিত, কৌশিক ব্যানার্জি, রঞ্জিত মল্লিক, প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জির বিপরীতে অভিনয় করে বহু হিট ছবি উপহার দিয়েছিলেন মহুয়া । মহুয়া রায়চৌধুরীকে তাকে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সফল অভিনেত্রী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার সহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছিলেন । এছাড়া ১৯৮৭ সালে পঞ্চম দামেস্ক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আদমি অর আওরাত (১৯৮৪1) চলচ্চিত্রে তার ভূমিকার জন্য মহুয়াকে মরণোত্তর সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার দেওয়া হয় । তার সময়ের খুব কম অভিনেত্রীই শাস্ত্রীয় এবং আধুনিক নৃত্য এতটা ভালভাবে জানতেন । মহুয়া তার চলচ্চিত্রে সফলভাবে নাচের শিল্পকে প্রবেশ করান, যা সেই সময়ে খুবই বিরল গুণ বলে বিবেচিত হয় ।
অভিনয় জীবনের শুরুর দিকেই মহুয়ার বিয়ে করেন প্রেমিক তিলক চক্রবর্তীকে ৷ তাঁদের কৈশোরের প্রেম পরিণয়ে রূপান্তরিত হয় কৈশোরেই৷ ১৯৭৬ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে পরিবারের অমতে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেন মহুয়া ৷ বাংলা ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করা তিলক পরে চাকরি করতেন ব্যাঙ্কে, কিশোরকণ্ঠী হয়ে গান গাইতেন মঞ্চে ৷ মহুয়ার বিয়ের পরের বছর নিজের জন্মদিনে ২৪ সেপ্টেম্বরেই মা হলেন ৷ গোঁড়া ইস্টবেঙ্গল ভক্ত ফুটবলপাগল মহুয়া ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘গোলা’, তিলক ও মহুয়ার নাম মিলিয়ে । ভাল নাম ‘তমাল’৷
কিন্তু শোনা যায় যে মৃতুর কয়েক বছর আগে থেকেই মদের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলে মহুয়া রায়চৌধুরী । জীবনে এসেছিলেন একাধিক পুরুষও ৷ ধীরে গ্রাস করছিল মানসিক অবসাদ । অবসাদের কারনে আত্মহত্যার পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন । তারপরই ঘটে গেল সেই অঘটন ।
কলকাতার বেহালার একটা ফ্লাটে স্বামী,শিশুপুত্র, বাবাকে নিয়ে ছিল মহুয়ার সংসার । ১৯৮৫ সালের ১২ জুলাই গভীর রাতে একটা পার্টি থেকে ক্লান্ত শরীরে ফ্লাটে ফেরেন মহুয়া রায়চৌধুরী । বর্ষণ মুখর ওই রাতে ঘটে যায় সেই ঘটনাটি । পরিবার দাবি করে যে বাড়ি ফেরার পর কেরোসিন স্টোভে ছেলের জন্য তিনি দুধ গরম করতে গিয়েছিলেন । আর তখনই স্টোভে বিস্ফোরণ হয়ে মহুয়ার গায়ে আগুন ধরে যায় । কিন্তু বাড়িতে দু’জন পরিচারক। তবু মহুয়া নিজে খাবার বা দুধ গরম করতে গেল কেন ? এই প্রশ্ন ওঠে । বাড়ির লোক বার বার বলেছেন স্টোভ বিস্ফোরণে দুর্ঘটনার কথা ৷ কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ যে স্টোভ উদ্ধার করেছে, তা ছিল অক্ষত ও কেরোসিন শূন্য ৷ অথচ মহুয়ার শরীরে কেরোসিনের গন্ধ ছিল ৷ আর ছিল চোখের কোনে,মুখে ও পিঠে ছিলে আঘাতের কালশিটে দাগ ৷ ফ্লাটের রান্নাঘরে আগুন লাগার কোন চিহ্ন ছিল না,অথচ মহুয়ার বেড রুমের বিছানা আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায় ।
মহুয়ার স্বামীর শরীরেও আঘাত ছিল সামান্য৷ শোনা যায়, সে রাতে স্বামী তিলকের সঙ্গে তীব্র বিবাদ হয়েছিল মদ্যপ মহুয়ার ৷ তবে মৃত্যুকালীন বয়ানে মহুয়া বলে গিয়েছেন অসাবধানতায় তাঁর গায়ে আগুন ধরে গিয়েছিল ৷ হাসপাতালের বেডে ঝলসানো শরীরে অস্ফুট উচ্চারণে শুধু কয়েকটা শব্দ শোনা গিয়েছিল মহুয়ার গলায়,’আমার গোলা রইল। ওকে দেখিস ।’ আর এতেই বোঝা যায় যে মহুয়া তার ছেলের কথা ভেবে কাউকে আড়াল করেছিলেন । মহুয়ার ভক্ত ও প্রিয়জনরাও সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ৷
মহুয়ার মৃত্যুকালীন জবানবন্দি নেন এনসি বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেণ্ট পুলিশ, সিআইডি এবং ইন্সপেক্টর এএন দুবে । সাক্ষী হিসেবে সই করেন দাদা পিনাকী রায়চৌধুরী এবং সিস্টার ঊষা । উপস্থিত ছিলেন রত্না ঘোষালও ।
মৃত্যুর সময় মহুয়া রায়চৌধুরীর কাঁধে ছ প্রায় ১৫ টি ছবি । মৃত্যুর পর তার অনুরাগের ছোয়া, প্রেম ও পাপ, অভিমান, আশির্বাদ, কেনারাম বেচারাম, আবির ইত্যাদি ছবি মুক্তিও পায় ।
মহুয়ার মৃত্যুর পর পরিবারের তরফ থেকে কোনও এফআইআর করা হয়নি। শোনা যায় যে তদন্ত প্রক্রিয়া চলার কিছুদিনের মধ্যে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধের নির্দেশ আসে ! ফলে আজও অভিনেত্রী মহুয়া রায়চৌধুরীর মৃত্যু রহস্য সর্বসমক্ষে আসেনি ।।