দেবাদিদেব মহাদেব হলেন শ্মশানবাসী, তিনি বাঘছাল পরে থাকেন,মাথায় জটা, আর ভূত-প্রেত নিয়েই তাঁর সংসার। তিনি সর্বদা ধ্যান মগ্ন হয়ে থাকেন, আবার প্রলয়ের সময় তিনি তান্ডব নৃত্য করেন। তাঁর সর্বাঙ্গে থাকে শ্মশানের ছাই মাখা, ষাঁড়ের(নন্দী মহারাজ) পিঠে চেপে তিনি সব জায়গায় ঘুরে বেড়ান এবং ডমরু বাজিয়ে মহানন্দে নৃত্য করেন। সর্বত্যাগী এই দেবতার গলায় থাকে সাপ। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী তিন আদি দেবতা হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। এর মধ্যে ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু নিয়ন্ত্রক এবং শিব অশুভ শক্তিকে ধ্বংসকারী। দেবাদিদেব মহাদেব প্রতিটি সনাতনি মানুষের কাছে বড্ড বেশি প্রিয় । কারন ‘ভাঙ খেয়ে শিব সদাই মত্ত,কেবল তুষ্ট বিল্বদলে’,অর্থাৎ সামান্য বেল পাতাতেই ভগবান শিবকে তুষ্ট করা যায় । শিব পূজার বিধিও সব থেকে সহজতর।
আসুন ভগবান দেবাদিদেব মহাদেব সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক :-
১)আদিনাথ শিব: শিবই প্রথম পৃথিবীতে জীবন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাই তাকে ‘আদিদেব’ বলা হয় । ‘আদি’ মানে শুরু। সেই কারনে তাঁর আর এক নাম হল ‘আদিশ’।
২) শিবের অস্ত্র: শিবের ধনুক হল পিনাক, চক্র হল ভবরেন্দু ও সুদর্শন, অস্ত্র হল পাশুপতস্ত্র ও ত্রিশূল। এসবের সৃষ্টি কর্তা হলেন মহাদেব ।
৩)শিবের সাপ: শিবের গলায় যে সাপ জড়িয়ে থাকে তার নাম বাসুকি। বাসুকির বড় ভাইয়ের নাম অবশিষ্টনাগ।
৩)শিবের উত্তম অর্ধেক: শিবের প্রথম স্ত্রী সতী পরের জন্মে পার্বতী রূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাকে উমা, ঊর্মি, কালী বলা হয়।
৪)শিবের পুত্র: শিবের ৬ টি প্রধান পুত্র রয়েছে; গণেশ, কার্তিকেয়, সুকেশ, জলন্ধর, আয়াপ্পা এবং ভূমা ।
৫)শিবের শিষ্য: শিবের ৭ জন শিষ্য রয়েছে যাদের প্রাথমিক সপ্তর্ষি বলে মনে করা হয়। এই ঋষিরাই শিবের জ্ঞান সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, যার কারণে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব হয়েছিল। শিবই গুরু-শিষ্য ঐতিহ্যের সূচনা করেছিলেন । শিবের শিষ্য বৃহস্পতি, বিশালাক্ষ, শুক্র, সহস্রাক্ষ, মহেন্দ্র, প্রচেতাস মনু, ভরদ্বাজ, এগুলি ছাড়াও অষ্টম গৌরাশিরস মুনিও ছিলেন।
৬) শিবের গণ: শিবের গণের মধ্যে ভৈরব, বীরভদ্র, মণিভদ্র, চণ্ডিস, নন্দী, শ্রৃঙ্গী, ভৃগিরিটি, শৈল, গোকর্ণ, ঘন্টকর্ণ, জয় ও বিজয় বিশিষ্ট। এ ছাড়া পিশাচ, রাক্ষস এবং সাপ এবং প্রাণীদেরও শিবের অনুচর বলে মনে করা হয়। শিবগন নন্দী ‘কামশাস্ত্র’ রচনা করেছিলেন। ‘কামসূত্র’ রচিত হয়েছিল ‘কামশাস্ত্র’ অবলম্বনে।
৭)শিব পঞ্চায়েত: ভগবান সূর্য, গণপতি, দেবী, রুদ্র ও বিষ্ণুকে শিব পঞ্চায়েত বলা হয়।
৮)শিবের দ্বাররক্ষক: নন্দী, স্কন্দ, রিতি, বৃষভ, ভৃঙ্গী, গণেশ, উমা মহেশ্বর এবং মহাকাল।
৯)শিবের উপদেষ্টাঃ জয় ও বিজয় যেমন বিষ্ণুর উপদেষ্টা, তেমনি বান, রাবণ, চাঁদ, নন্দী, ভৃঙ্গী প্রভৃতি শিবের উপদেষ্টা।
১০)শিব, সমস্ত ধর্মের কেন্দ্র: শিবের পোশাক এমন যে প্রতিটি ধর্মের লোকেরা তাদের মধ্যে তাদের প্রতীক খুঁজে পেতে পারে। মুশরিক, ইয়াজিদি, সাবিন, সুবি এবং আব্রাহামিক ধর্মে শিবের উপস্থিতির ছাপ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। একটি ঐতিহ্য শিবের শিষ্যদের সাথে শুরু হয়েছিল, যা পরবর্তীতে শৈব, সিদ্ধ, নাথ, দিগম্বর এবং সুফি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছিল।
১১)বৌদ্ধ সাহিত্যের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত, অধ্যাপক উপাসক বিশ্বাস করেন যে শঙ্কর নিজেই বুদ্ধরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পালি গ্রন্থে উল্লিখিত ২৭টি বুদ্ধের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মধ্যে বুদ্ধের ৩টি নাম অতি প্রাচীন; তনঙ্কর, শানাঙ্কর ও মেঘানকর।
১২)শিব দেবতা এবং দানব উভয়েরই প্রিয়: ভগবান শিবকে দেবতাদের সাথে সমস্ত রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্ব, যক্ষ ইত্যাদি দ্বারা পূজা করা হয়। তিনি রাবণ এবং রামকেও বর দেন। তিনি ভস্মাসুর, শুক্রাচার্য প্রভৃতি অনেক রাক্ষসকে বর দিয়েছিলেন। শিব হলেন সমস্ত আদিবাসী, বনবাসী বর্ণ, ধর্ম ও সমাজের পরম দেবতা।
১৩)শিব প্রতীক: যে প্রতীকটিকে বনবাসী থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই পূজা করতে পারেন, সেই পাথরের পিণ্ড বা পাত্রটিকে শিবের প্রতীক বলে মনে করা হয়। এছাড়া রুদ্রাক্ষ ও ত্রিশূলকেও শিবের প্রতীক মনে করা হয়। কিছু লোক ডমরু এবং অর্ধচন্দ্রকে শিবের প্রতীক হিসাবেও বিবেচনা করে, যদিও বেশিরভাগ লোক শিবলিঙ্গ অর্থাৎ শিব জ্যোতিকে পূজা করে ।
১৫)শিবের গুহা: ভস্মাসুর থেকে পালানোর জন্য শিব তার ত্রিশূল দিয়ে একটি পাহাড়ে একটি গুহা তৈরি করেছিলেন এবং তারপর তিনি একই গুহায় লুকিয়ে ছিলেন। সেই গুহাটি জম্মু থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে ত্রিকুটা পাহাড়ে। অন্যদিকে, যে গুহাটিতে ভগবান শিব পার্বতীকে জ্ঞানের অমৃত দিয়েছিলেন তা ‘অমরনাথ গুহা’ নামে বিখ্যাত।
১৬)শিবের পায়ের ছাপ: শ্রীপদ শ্রীলঙ্কার রতন দ্বীপ পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত শ্রীপদ নামক একটি মন্দিরে শিবের পায়ের ছাপ রয়েছে। এই পায়ের ছাপগুলি ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা এবং ২ ফুট ৬ ইঞ্চি চওড়া। এই স্থানের নাম শিভানোলিপদম। কেউ কেউ একে অ্যাডামস পিক বলে।
রুদ্র পদম: তামিলনাড়ুর নাগাপট্টিনম জেলার তিরুভেনগাডু এলাকায় শ্রী স্বেদারনেশ্বরের মন্দিরে শিবের পদচিহ্ন রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রুদ্র পদম’। এছাড়াও তিরুভান্নামালাইতেও একটি জায়গায় ভগবান মহাদেবের পায়ের ছাপ রয়েছে।
তেজপুর: আসামের তেজপুরে ব্রহ্মপুত্র নদীর কাছে অবস্থিত রুদ্রপদ মন্দিরে শিবের ডান পায়ের ছাপ রয়েছে। জাগেশ্বর: উত্তরাখণ্ডের আলমোড়া থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে জগেশ্বর মন্দিরের পাহাড় থেকে প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে ভীমের মন্দিরের কাছে শিবের পায়ের ছাপ রয়েছে। পাণ্ডবদের দর্শন এড়াতে তিনি একটি পা এখানে এবং অন্য পা কৈলাসে রেখেছিলেন।।